প্রবন্ধ

শিরক ও তার ভয়াবহ পরিণতি

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যানি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

শিরক ও তার ভয়াবহ পরিণতি

ভূমিকা :

পৃথিবীরইতিহাসে প্রবহমান পাপ সমূহের মধ্যে শিরকসর্বাপেক্ষা বড় পাপ হিসাবে স্বীকৃত। শিরকেরচেয়ে জঘন্য কোন পাপ নেই।অন্যান্য পাপ মহান আল্লাহ সহজেই মাফ করে দেন। কিন্তুশিরকের পাপ সহজে মাফকরেন না। শিরকের অপরাধের জন্য বিনয়-নম্রতার সাথে তওবা করতেহয়। শিরককেকাবীরা গুনাহ সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় কাবীরা গুনাহ হিসাবে উল্লেখকরাহয়েছে। আব্দুর রহমান ইবনু আবুবকর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতাবলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ছিলাম। তিনি বললেন, আমিতোমাদের সবচেয়ে বড়তিনটি পাপের কথা বলব কী? ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ হেআল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনিবললেন, ‘আল্লাহর সাথে শিরক করা, পিতা-মাতারঅবাধ্য হওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকরা’।[1]শিরক এক অমার্জনীয় অপরাধ। আনাস (রাঃ) বলেন, আমিরাসূলুল্লাহ(ছাঃ)-কেবলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তুমি যদিআমার নিকটযমীন ভর্তি পাপ নিয়ে আস, আর শিরক মুক্ত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ কর।তাহলে আমি ঐ যমীন ভর্তি পাপ ক্ষমা করে দিব’।[2]তাই বুঝা যায়, শিরকের মত জঘন্য পাপ পৃথিবীতেদ্বিতীয়টি নেই। যার কারণেপ্রত্যেক নবী ও রাসূলগণ শিরকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেগেছেন। কোন নবী ওরাসূলকে শিরকের সাথে আপোস করতে দেখা যায়নি। তাঁরা প্রত্যেকেছিলেন শিরকেরসাথে আপোসহীন।

শিরকেরশাব্দিক পরিচিতি :

ইবনু মানযুর বলেছেন, ‘আশ-শিরকাতু’ ও ‘আশ-শারকাতু’ الشركة و الشركةসমার্থবোধক দু’টি শব্দ। যার অর্থ হল, দু’শরীকের সংমিশ্রণ। তিনি আরো বলেন, ‘ইশতারাকানা’ إشتركنا ‘আমরা শরীক হলাম’ শব্দের অর্থ হল, ‘তাশারাকানা’ تشاركنا ‘আমরা পরস্পর শরীক হলাম’। দু’জন শরীক হল আর পরস্পর শরীক হল বা একে অপরেরসাথে শরীক হল কিংবা শরীক হওয়া এ সকল শব্দের অর্থ হল, ‘আল-মুশারিক’ المشاركবা অংশীদার। ‘আশ-শিরকু’ الشركশব্দটিও শরীক করা ও শরীক হওয়ারমতই। এর বহুবচন হল ‘ইশরাক’ ও শুরাকা-উ’ إشرك و شركاء ‘সকল শরীকান বা অংশীদার’।[3]

আল-মুনজিদ নামক অভিধানে বলা হয়েছে, أشرك في أمرهঅর্থাৎ ‘তার কাজে সে (অপর কাউকে) শরীক করে নিয়েছে’।أشرك با اللهঅর্থাৎ ‘আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে’।আর যে তা করল সে মুশরিক হয়ে গেল।[4]

শেখ যাকারিয়া বলেন, শিরক শব্দমূলটি সংমিশ্রণ ওএকত্রিকরণের অর্থ প্রকাশ করে। কোন বস্ত্তর অংশ বিশেষ যখন একজনের হবে, তখনএরঅবশিষ্ট অংশ অপর এক বা একাধিক জনের হবে।[5]যেমন আল্লাহ বলেন, أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ ‘তবে কি আকাশমন্ডলীতে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে’ (আহক্বাফ ৪৬/৪)

উপরোক্তবর্ণনার আলোকে প্রমাণিত হয় যে, ‘শিরক’ শব্দটিমূলগতভাবেই মিশ্রণ ও মিলনের অর্থপ্রকাশ করে এবং এ মৌলিক অর্থটি এর সকলরূপান্তরিত শব্দের মধ্যে নিহিত থাকে। আর দুইবা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যকারঅংশীদারিত্ব যেমন ইন্দ্রিয় অনুভূত বস্ত্তসমূহের মধ্যেহতে পারে, তেমনি তাকোন অর্থগত বা গুণগত বস্ত্ততেও হতে পারে।[6]

শিরকেরপারিভাষিক পরিচিতি :

ড.ইবরাহীম বরীকান শিরকের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায় বলেন, গায়রুল্লাহকে আল্লাহরবৈশিষ্ট্যের সমকক্ষ করা। সমকক্ষ বলতে এখানে মুক্তশরীকানা বুঝানো হয়ে থাকে, শরীকানায় আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহ-এর অংশের সমানহতে পারে অথবা আল্লাহর অংশগায়রুল্লাহ-এর অংশের চেয়ে অধিকও হতে পারে।[7]

তিনি শিরকের আরেকটি অর্থ নিয়েছেন যে, আল্লাহর পাশাপাশিগায়রুল্লাহকে উপাস্য ও মান্যবর হিসাবে গ্রহণ করা। কুরআন, সুন্নাহ ওঅগ্রবর্তীমনীষীগণের কথায় শিরক শব্দটি যখন সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন এরদ্বারা শিরকেরদ্বিতীয়  অর্থই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।[8]

মূলতঃ শিরক হচ্ছে সৃষ্টি ও স্রষ্টার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণহওয়া বা সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করা। অর্থাৎ স্রষ্টা হওয়ারজন্য যেসব গুণাবলী দরকার, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোন লোক সৃষ্টিকে স্রষ্টারসাথে তুলনা বাসাদৃশ্যপূর্ণ  করলে, সে মুশরিক হয়ে যাবে।[9]

আল্লাহর সাথে শিরক করার অর্থ হল- বান্দা কোন ব্যক্তিকেআল্লাহর সমকক্ষ মনে করে, তার নিকট প্রার্থনা করে, কোন কিছু আশা করে, তাকেভয় করে, তার উপর ভরসা করে, তার নিকট সুপারিশ চাওয়া, তার নিকট বিপদ থেকেউদ্ধারের জন্যফরিয়াদ করা, কিংবা তার নিকট এমন বিষয়ে সাহায্য প্রার্থনাকরা, যার সমাধান আল্লাহছাড়া অন্য কেউ দিতে পারে না, অথবা তার নিকটমিমাংসা চাওয়া, কিংবা আল্লাহরঅবাধ্যতা করে তার আনুগত্য করা, অথবা তার কাছথেকে শরী‘আতের বিধান গ্রহণ করা কিংবাতার জন্য (বা তার নামে) যবহ করা, অথবা তার নামে মানত করা, অথবা তাকে এতটুকুভালবাসা যতটুকু আল্লাহকেভালবাসা উচিৎ।

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যে সকল কথা, কাজ ও বিশ্বাসকেওয়াজিব বা মুস্তাহাবরূপে নির্ধারণ করেছেন, সেগুলোর সব কিংবা কোন একটিগায়রুল্লাহতথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদেশ্যে করাই হল শিরক।

শিরকের প্রকারভেদ :

প্রকৃতপক্ষে শিরক তিন ভাগে বিভক্ত। (ক) শিরকে আকবার বাবড় শিরক (খ) শিরকে আছগার বা ছোট শিরক (গ) শিরকে খাফী বা গোপন শিরক।

শিরকে আকবার বা বড় শিরক :

বিশ্বাস জাতীয় বিষয়াদী ও উপাসনার ক্ষেত্রে আল্লাহতা‘আলার সাথে কাউকে শরীক বা সমান করাই মূলতঃ শিরকে আকবার।

আবার কেউ সংজ্ঞা প্রদান প্রসঙ্গে বলেন, শিরকে আকবার হচেছ, আল্লাহর সাথে কাউকে শিরক করা। যেমন অন্যকে আহবান করা, অন্যের নিকট কিছুকামনাকরা, অন্যকে ভয় করা, অন্যকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসা, অন্যের জন্য পশুউৎসর্গ বামানত করা।

কেউ কেউ বলেন, আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহকে আহবান করাইহচ্ছে শিরকে আকবার।[10]

আবার কেউ বলেন, আল্লাহর উপাসনা সমূহের কোন উপাসনাগায়রুল্লাহ-এর উদ্দেশ্যে করাকে শিরকে আকবার বলা হয়।[11]

আল্লাহ তা‘আলার নামাবলী ও গুণাবলীর যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যে বৈশিষ্টগুণে তিনি আমাদের একক রব ও উপাস্য, আমাদের রাসূল (ছাঃ) বা কোনঅলি-দরবেশ, জিন-পরী বা গ্রহ-তারা, গাছ-পালা ও পাথর ইত্যাদিকে সে সববৈশিষ্ট্যেরকোন না কোন বৈশিষ্ট্যের সমান বা আংশিক অধিকারী বলে মনে করাএবং নবী, অলি, গাছ-পালাও পাথর ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে শরীরেরঅঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অন্তর দ্বারা উপাসনামূলককোন কর্ম করাকে শিরকে আকবার বলাহয়।

এরূপ শিরককারীর পরিণতি হল চিরস্থায়ী জাহান্নাম। যেমনমহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ  ‘

যে আল্লাহর সাথে অন্য কাইকে শরীক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারামকরে দিবেন এবং তার আবসস্থল হবে জাহান্নাম’ (মায়েদা ৫/৭২)

শিরকে আছগার বা ছোট শিরক :

শিরকে আকবার নয় এমন যে সব কর্মকে শরী‘আতে সুস্পষ্টপ্রমাণ দ্বারা শিরক বলে নাম করণ করা হয়েছে, সেগুলোই হচ্ছে শিরকে আছগার।যেমন কেউ বলল, ‘আল্লাহ আর আপনি যা চান’। ‘আল্লাহ আর আপনি যদি উপস্থিত নাথাকতেন, তাহলে আমার মহাবিপদ হয়ে যেত’। অনুরূপভাবে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারোনামে শপথ করা ইত্যাদি।[12]

ড. ইবরাহীম বরীকান শিরকের সংজ্ঞায় বলেন, ‘আমলের ক্ষেত্রেগায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার সমান মনে করাকে শিরকে আছগার বলা হয়’। যেমনকোন কাজে ওকথায় লোক দেখানোর ভাব করা।[13]

ইমাম ইবনুল ক্বইয়িম শিরকে আছগারের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘উপাসনায় লোক দেখানোর ভাব করা, মানুষের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা, আমিআল্লাহ ও আপনার উপর ভরসা করেছি এমনটি বলা, আল্লাহ ও আপনি না হলে এমনটিহত। এ সবউদাহরণ প্রদানের পর তিনি বলেন, শিরকে আছগার কখনো কর্তা ব্যক্তিরমানসিক অবস্থা ওউদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে শিরকে আকবারেও রূপান্তরিত হতেপারে’।[14]

আবার কারো কারো মতে, শিরকে আছগার হল- ‘এমন সব কথা বা কাজ, যা বাহ্যিকভাবে গায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সমান করে নেয়া হয়েছেবলেপ্রতীয়মান হয়, যদিও এই সমকক্ষ বানানোটা কর্তা ব্যক্তির উদ্দেশ্য নয়’।[15]

নিম্নোক্ত উদাহরণ গুলোতে শিরকে আছগারের পরিচয় খুঁজেপাওয়া যায়। যেমনভাবে মানুষেরা বলে থাকে, আল্লাহ আর এই পোষা কুকুরটি না হলেআজ রাতেআমার বাড়ীতে চুরি হয়ে যেত। আল্লাহ এবং আপনি না হলে আজকে মহা অঘটনঘটে যেত। আমিমাটি হাতে নিয়ে বা মায়ের নাম নিয়ে বা সন্তানের মাথায় হাতরেখে বা চোখের বা দানাছুঁয়ে শপথ করে বলছি। আমি আল্লহর অনুগ্রহে এবংআপনাদের দো‘আয় ভাল আছি ইত্যাদিধরনের কথা বলা।(চলবে)

 

[1]. ছহীহ বুখারী হা/২৬৬৪, ১/৩৬২ পৃঃ; ছহীহ মুসলিম হা/২৫৫, ১/৬৪ পৃঃ।

[2]. তিরমিযী হা/৩৫৪০; মিশকাত হা/২৩৩৬, সনদ ছহীহ।

[3]. ইবনু মানজুর, লিসানুল আরব, الشركশব্দমূল (১৮০৫ হিঃ), ১০/৪৪৮-৪৫০ পৃঃ।

[4]. অধ্যাপক আনতুয়ান, আল-মুনজিদ (বৈরুত : দারুলমাশারিক, ২১ তম সংস্করণ, ১৯৭২ খ্রিঃ), পৃঃ ৩৮৪।

[5]. ড. মুহাম্মাদ মুযযাম্মিল আলী, শিরক কী ও কেন? (সিলেট : এডুকেশন সেন্টার, ১ম প্রকাশ জুলাই-২০০৭ ইং), পৃঃ ২৯।

[6]. শিরক কী ও কেন? পৃঃ ৩০।

[7]. ড.ইব্রাহীম বরীকান, আল-মাদখালু লিদেরাসাতিল ‘আক্বীদাতিল ইসলামিয়্যাহ ‘আলামাযহাবি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ (আল-খুবাব :দারুস সুন্নাহ লিন নসরিওয়াত তাওযী, ১৯৯২ ইং), পৃঃ ১২৫।

[8]. আল-মাদখালু লিদেরাসাতিল ‘আক্বীদাতিলইসলামিয়্যাহ ‘আলা মাযহাবি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ১২৬।

[9]. মূল :আলী বিন নুফায়ী আল-উলাইয়ানী, অনুবাদ :ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ মুজিবুররহমান, আক্বীদার মানদন্ডে তা’বিয (ঢাকা : ইসলামীঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, প্রকাশকাল : রামাযান ১৪১৭ হিঃ, ১৯৯৭ ঈসায়ী), পৃঃ ২৫।

[10]. শিরক কী ও কেন?, পৃঃ ৫৮।

[11]. আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মাদ আস-সালাম, আল-আসইলাতুওয়াল আজইবাতিল উছূলিয়্যাতি ‘আলাল ‘আক্বীদাতিল ওয়া-সিতিয়্যাতি লি ইবনে তাইমিয়্যাহ (২১তম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রিঃ), পৃঃ ৫৮।

[12]. ‘আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যা, লে ইবনে তাইমিয়্যাহপৃঃ ১৭০।

[13]. ড. ইব্রাহীম বরীকান, প্রাগুক্ত পৃঃ ১২৬।

[14]. আশ-শায়খ সুলাইমান ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মুনী, তাইসীরুল ‘আযীযিল হামীদ ফীশরহে কিতাবিত তাওহীদ (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১মসংস্করণ, ১৪০২ হিঃ), পৃঃ ৪৫।

[15]. শিরক কী ও কেন? পৃঃ ৬২।

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button