প্রবন্ধ

লাইলাতুল মি‘রাজ রজনীতে করণীয় ও বর্জনীয়

প্রবন্ধটি পড়া শেষ হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুনাময় অতি দয়ালু।

লাইলাতুল মি‘রাজ রজনীতে করণীয় ও বর্জনীয়

মি‘রাজ’ সংঘটিত হয়েছিল রজব মাসে। মি‘রাজ ইসলামের ইতিহাসে এমনকি পুরা নবুওয়াতের ইতিহাসেও এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। কারণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছাড়া অন্য কোন নবী এই সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি। আর এ কারণেই মুহাম্মাদ (ছাঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। এ মি‘রাজ রজনীতেই মানব জাতির শ্রেষ্ঠ ইবাদত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয়। মি‘রাজ (مِعْرَاجٌ) আরবী শব্দ, অর্থ সিঁড়ি। শারঈ অর্থে বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে যে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সপ্ত আসমানের উপরে আরশের নিকটে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই সিঁড়িকে ‘মি‘রাজ’ বলা হয়। পারিভাষিক অর্থে হিজরতের পূর্বে একটি বিশেষ রাতের শেষ প্রহরে বায়তুল্লাহ হ’তে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ‘বোরাক্বে’ ভ্রমণ, অতঃপর সেখান থেকে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে সপ্ত আসমান পেরিয়ে আরশে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন ও পুনরায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস হয়ে বোরাক্বে আরোহণ করে প্রভাতের আগেই মক্কায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের ঘটনাকে ‘মি‘রাজ’ বলা হয়।[1]‘ইসরা’ (اِسْرَاءٌ) শব্দের অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। ‘ইসরা’ বলতে মি‘রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত সফরকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ ‘ইসরা’ হ’ল যমীন থেকে যমীনে ভ্রমণ। আর যমীন থেকে ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণকে মি‘রাজ বলা হয়। কুরআন মাজীদের সূরা বানী ইসরাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নাজমের ১৩ থেকে ১৯ আয়াত পর্যন্ত ‘মিরাজে’র ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া ২৬-এর অধিক ছাহাবী কর্তৃক বুখারী, মুসলিমসহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে মুতাওয়াতির পর্যায়ে মি‘রাজের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং মি‘রাজ অকাট্যভাবে প্রমাণিত একটি সত্য ঘটনা। যাতে সন্দেহ পোষণের কোন অবকাশ নেই। মি‘রাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা : একদা রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বার হাতীমে, অন্য বর্ণনায় নিজ গৃহে (উম্মে হানীরা ঘরে) ঘুমিয়ে ছিলেন। রাতের শেষভাগে জিবরীল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশমতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে বোরাক্বের পিঠে আরোহণ করিয়ে বায়তুল্লাহ থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে তিনি বোরাক্বটিকে একটি পাথরের সাথে বেঁধে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তাঁর নিকট ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণের বিশেষ বাহন উপস্থিত করা হয়। মতান্তরে ঐ বোরাক্বের মাধ্যমে জিবরীল (আঃ) তাঁকে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত নিয়ে যান। পথিমধ্যে প্রথম আসমানে আদম (আঃ), দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ), তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আঃ), চতুর্থ আসমানে ইদরীস (আঃ), পঞ্চম আসমানে হারূণ (আঃ), ষষ্ঠ আসমানে মূসা (আঃ) এবং সপ্তম আসমানে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়। অতঃপর জান্নাত-জাহান্নাম ও ‘বায়তুল মা‘মূর’ পরিদর্শন করেন। সিদরাতুল মুনতাহা পৌঁছে জিবরীল (আঃ) তাঁকে তথায় একা রেখে চলে যান। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘রফরফ’ বাহন আরশ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এক টুকরা মেঘ আচ্ছাদিত করে ফেলে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। এ সময় মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার অতীব নিকটে আসেন এবং তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ সময় উভয়ের মাঝে দূরত্ব ছিল দুই ধনুক বা দুই গজেরও কম। তখন আল্লাহ তাঁকে অহী করেন- ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى، فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى، فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى– ‘অতঃপর নিকটবর্তী হ’ল, সে তার অতি নিকটবর্তী। তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল বা তারও কম। তখন আল্লাহ স্বীয় বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা করলেন’ (নাজম ৫৩/৮-১০)। আললাহ পাক উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য ৫০ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর থেকে মেঘমালা সরে গেলে তিনি জিবরীল (আঃ)-এর সাথে দুনিয়াতে ফিরে আসার জন্য রওনা দেন। পথিমধ্যে ষষ্ঠ আসমানে মূসা (আঃ) তাঁকে মি‘রাজের প্রাপ্তি ও প্রত্যাদেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁকে ৫০ ওয়াক্ত ছালাতের কথা বলেন। মূসা (আঃ) তাঁকে পুনরায় আল্লাহর নিকট ফিরে গিয়ে ছালাতের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য পরামর্শ দিলেন। মূসা (আঃ)-এর পীড়াপীড়িতে রাসূল (ছাঃ) কয়েকবার আল্লাহর নিকট যান এবং ছালাতের ওয়াক্তের পরিমাণ হরাস করার অনুরোধ করেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় অনুগ্রহে ৫০ ওয়াক্ত ছালাতকে কমাতে কমাতে ৫ ওয়াক্ত করে দেন, যা ৫০ ওয়াক্তের ফযীলতের সমান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বচক্ষে জান্নাত, জাহান্নাম, বায়তুল মা‘মূর, মাকামে মাহমূদ, হাওযে কাওছার ইত্যাদি পরিদর্শন করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন আসমানে যে সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তারাও তাঁর সাথে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে অবতরণ করেন। অতঃপর তিনি আম্বিয়ায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে সেখানে দু’রাক‘আত ছালাতের ইমামতি করেন। (কারো মতে সেটি ছিল ফজরের ছালাত)। ছালাত শেষে তাঁকে জাহান্নামের দারোগা ‘মালেক’ ফেরেশতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর বোরাক্বে আরোহণ করে অন্ধকার থাকা অবস্থায় তিনি পুনরায় মক্কায় নিজ গৃহে ফিরে আসেন।[2] মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার সময়কাল : মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার সঠিক তারিখ বা দিনক্ষণ সম্পর্কে মুহাদ্দিছীন ও ওলামায়ে কেরামের মাঝে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আর-রাহীকুল মাখতূম-এর লেখক ছফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) এ বিষয়ে ৬টি মতামত উল্লেখ করেছেন। যথা- (১) নবুওয়াত প্রাপ্তির বছর, (২) ৫ম নববী বর্ষে, (৩) ১০ম নববী বর্ষের ২৭শে রজব রাতে, (৪) কেউ বলেছেন, হিজরতের ১৬ মাস পূর্বে ১২ নববী বর্ষের রামাযান মাসে, (৫) কেউ বলেছেন, হিজরতের ১৪ মাস পূর্বে ১৩ নববী বর্ষের মুহাররম মাসে এবং (৬) কেউ বলেছেন, হিজরতের এক বছর পূর্বে ১৩ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে। অতঃপর মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, প্রথম তিনটি মত গ্রহণযোগ্য নয় এ কারণে যে, খাদীজা (রাঃ) ১০ম নববী বর্ষের রামাযান মাসে মারা গেছেন। আর তখনও পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয়নি। আর এ বিষয়ে সকলে একমত যে, ছালাত ফরয হয়েছে মি‘রাজের রাত্রিতে। বাকী তিনটি মত সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলোর কোনটিকে আমি অগ্রাধিকার দেব তা ভেবে পাই না। তবে সূরা বানী ইসরাঈলে বর্ণিত আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ‘ইসরা’র ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনের একেবারে শেষের দিকে হয়েছিল।[3] কারো মতে ৬২০ বা ৬২১ খৃষ্টাব্দে নবুওয়াতের দশম বছরের রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছে। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) খ্যাতনামা জ্যেষ্ঠ তাবেঈ ইবনু শিহাব যুহরীর বরাতে বলেন, হিজরতের এক বছর পূর্বে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল।[4] অতএব নির্দিষ্টভাবে ২৭শে রজব দিবাগত রাতে মি‘রাজ হয়েছিল বলে যে কথা পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত আছে তা নিতান্তই দলীলবিহীন।[5] অন্যান্য ধর্মের লোকের ন্যায় মুসলমানরাও যাতে ধর্মের নামে অহেতুক আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী না হয়ে পড়ে সে কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্ম দিন, লায়লাতুল ক্বদর ইত্যাদির ন্যায় লায়লাতুল মি‘রাজের দিন-তারিখকেও ভুলিয়ে দেওয়ার মধ্যে মহান আল্লাহর পূর্ণ কৌশল নিহিত আছে বলে অনুমিত হয়। মি‘রাজের প্রাপ্তি : মি‘রাজে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে স্বীয় সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে উম্মতে মুহাম্মাদীকে পুরস্কার স্বরূপ তিনটি বিষয় প্রদান করেন। যথা- (১) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত। যা ফযীলতের দিক দিয়ে ৫০ ওয়াক্তের সমান। সুতরাং ছালাত হ’ল উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কারণ ছালাতের মাধ্যমেই মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ঘটে। আর নৈতিক উন্নতিই হ’ল সকল উন্নতির চাবিকাঠি। (২) সূরা বাক্বারাহর শেষের কয়েকটি আয়াত (২৮৫-৮৬)। কারণ এ আয়াতগুলোতে উম্মতের প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত ও অনুগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। (৩) উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে যারা কখনো শিরক করেনি, তাদেরকে ক্ষমা করার সুসংবাদ। কারণ শিরক হ’ল পাপসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ (লোক্বমান ৩১/১৩)। মহান আল্লাহ অন্য কোন পাপের কারণে সরাসরি জান্নাত হারাম ঘোষণা করেননি শিরক ব্যতীত (মায়েদাহ ৫/৭২)। আর একমাত্র শিরকের গোনাহ ছাড়া অন্যান্য গোনাসমূহ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন (নিসা ৪/৪৮)। উল্লেখ্য যে, মিরক্বাত, রাদ্দুল মুহতার, মিসকুল খিতাম প্রভৃতি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে যে, মি‘রাজে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘আত্তাহিইয়াতু’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অথচ একথার স্বপক্ষে কোন বিশুদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায় না। অতএব ভিত্তিহীন এ সমস্ত বক্তব্য থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। মি‘রাজের উদ্দেশ্য ও শিক্ষা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মি‘রাজ তথা ঊর্ধ্বলোকে গমনের উদ্দেশ্য ব্যাপক। মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নবুওয়াতী জীবনে মি‘রাজের মত এক মহিমান্বিত ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পেছনে যে কারণগুলো মুখ্য তা হ’ল- (১) মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে হাযির হওয়া, (২) ঊর্ধ্বলোক সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন, (৩) অদৃশ্য ভাগ্য সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান লাভ, (৪) ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, (৫) স্বচক্ষে জান্নাত-জাহান্নাম অবলোকন, (৬) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের সাথে সাক্ষাৎ ও পরিচিত হওয়া, (৭) সুবিশাল নভোমন্ডল পরিভ্রমণ করা এবং (৮) সর্বোপরি এটিকে একটি অনন্য মু‘জিযা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। মি‘রাজের শিক্ষা সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে ‘আবদ’ বা দাস বলে সম্বোধন করেছেন। এর মর্মার্থ এই যে, বান্দার জন্য এর চেয়ে সম্মানিত কোন নাম আল্লাহর কাছে নেই, থাকলে অবশ্যই সে নামে রাসূল (ছাঃ)-কে সম্বোধন করে সম্মানিত করা হ’ত। আর মি‘রাজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হ’ল সর্বপ্রকার গর্ব-অহংকার চূর্ণ করে আল্লাহর সবচেয়ে বড় দাস হওয়ার চেষ্টা করা। কারণ দাসত্বের মধ্যেই সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদা নিহিত রয়েছে। অতএব জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর দাসত্ব করা ও ছালাতের হেফাযত করাই হ’ল মি‘রাজের সবচেয়ে বড় এবং মূল শিক্ষা। মি‘রাজ উপলক্ষে করণীয় ও বর্জনীয় : আমাদের দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে মি‘রাজ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, দো‘আ, মীলাদ, ওয়ায মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠানে শবে মি‘রাজের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে বহু বানোয়াট কল্প-কাহিনী ও ভিত্তিহীন জাল-মওযূ‘ হাদীছের বর্ণনা শোনা যায়। যার দু’একটি নিম্নরূপ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রজব মাসের ২৭ তারিখ অর্থাৎ মি‘রাজ দিবসে ছিয়াম পালন করবে, তার আমলনামায় ৬০ মাসের ছিয়ামের নেকী লেখা হবে’। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ২৭ রজব (অর্থাৎ মি‘রাজের রাত্রিতে) ইবাদত করবে, তার আমলনামায় একশ’ বছরের ইবাদতের ছওয়াব লেখা হবে’। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতের ছালাতের ব্যাপারে ওলামায়ে ইসলাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, এটি প্রমাণযোগ্য নয়।[6] মি‘রাজ উপলক্ষে রজব মাসের ফযীলত সম্পর্কেও বহু জাল হাদীছ শোনা যায়। তন্মধ্যে কতিপয় নিম্নে উদ্ধৃত হ’ল- ১. আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রজবের প্রথম রজনীতে মাগরিবের ছালাতের পর বিশ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, যার প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা ও সূরা ইখলাছ পড়বে …’। অতঃপর দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইবনুল জাওযী বলেন, হাদীছটি মওযূ বা জাল।[7] ২. ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রজবের দিবসে ছিয়াম পালন করবে এবং চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, যার প্রথম রাক‘আতে একশত বার আয়াতুল কুরসী পড়বে…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ইবনুল জাওযী বলেন, হাদীছটি মওযূ। এর সনদে ওছমান নামক রাবী মুহাদ্দিছগণের দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত।[8] ৩. আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রজবের রজনীতে চৌদ্দ রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, যার প্রত্যেক রাক‘আতে সূরা ফাতিহা একবার, কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ বিশবার, কুল আঊযু বিরবিবল ফালাক্ব তিনবার, কুল আঊযু বিরবিবন নাস তিনবার পড়বে। অতঃপর ছালাত হ’তে ফারেগ হয়ে দশবার দরূদ পড়বে… ’ ইত্যাদি। ইবনুল জাওযী বলেন, হাদীছটি মওযূ।[9] আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর নামে বর্ণিত জাল হাদীছে আছে যে, রাসূল (ছাঃ) নাকি বলেছেন, ‘রজব মাস আল্লাহর মাস, শা‘বান মাস আমার মাস এবং রামাযান মাস উম্মতের মাস। অতএব যে ব্যক্তি ঈমানের অবস্থায় নেকীর আশায় রজবের ছিয়াম পালন করবে তার জন্য আল্লাহর মহা সন্তোষ অবধারিত হয়ে যায় এবং তাকে তিনি জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দিবেন…। যে ব্যক্তি রজব মাসে ২ থেকে ১৫টি ছিয়াম পালন করবে, তার নেকী পাহাড়ের মত হবে… সে কুষ্ঠ, শ্বেত ও পাগলামী রোগ থেকে মুক্তি পাবে। … জাহান্নামের সাতটি দরজা তার জন্য বন্ধ থাকবে। … জান্নাতের আটটি দরজা তার জন্য খোলা থাকবে’। জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহঃ) বলেন, হাদীছটি জাল।[10] অতএব রজব মাসের সম্মানে বিশেষ ছিয়াম পালন করা, ২৭শে রজবের রাত্রিকে শবে মি‘রাজ ধারণা করে ঐ রাতকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা, উক্ত উদ্দেশ্যে বিশেষ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা, যিকির-আযকার, শাবীনা খতম ও দো‘আর অনুষ্ঠান করা, মীলাদ ও ওয়ায মাহফিল করা, ঐ রাতের ছওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, সরকারী ছুটি ঘোষণা করা ও তার ফলে জাতীয় অর্থনীতির বিশাল অংকের ক্ষতি করা, ছহীহ হাদীছ বাদ দিয়ে মি‘রাজের নামে উদ্ভট সব গল্পবাজি করা, মি‘রাজকে বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করতে গিয়ে অনুমান ভিত্তিক কথা বলা, ঐ দিন আতশবাজি, আলোকসজ্জা, কবর যিয়ারত, দান-খয়রাত এবং এ মাসের ফযীলত লাভের আশায় ওমরাহ পালন ইত্যাদি সবই বিদ‘আতের পর্যায়ভুক্ত।[11] অতএব মি‘রাজ উপলক্ষে পালিত উল্লিখিত বিদ‘আত সমূহ বর্জন করে বরং আল্লাহর নির্দেশ মেনে এ দিনের ও মাসের সম্মানে মারামারি, খুনা-খুনি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে দূরে থাকাই বড় নেকীর কাজ। জাহেলী যুগের কাফেররাও এ মাসের সম্মানে আপোষে ঝগড়া-ফাসাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখত। অথচ মুসলমানরা আজ পর্যন্ত আল্লাহর হুকুম মেনে তাঁর সম্মানে আপোষে হানাহানি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে বিরত হ’তে পারেনি। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। মহান আল্লাহ আমাদেরকে মি‘রাজের প্রকৃত শিক্ষা উপলব্ধি করে শিরক-বিদ‘আতসহ সর্বপ্রকার গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন! [1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মি‘রাজ, মাসিক আত-তাহরীক, ৭ম বর্ষ, ১২তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-২০০৪, পৃঃ ৩। [2]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬, ‘মি‘রাজ’ অধ্যায়। [3]. মাসিক আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর-২০০৪, পৃঃ ৭। [4]. তদেব। [5]. মাসিক আত-তাহরীক, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, নভেম্বর-১৯৯৭, পৃঃ ৯। [6]. আত-তাহরীক, ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর-১৯৯৮, পৃঃ ২২। [7]. কিতাবুল মওযূ‘আত, ২য় খন্ড (বৈরুত ছাপা), পৃঃ ১২৩। [8]. তদেব। [9]. তদেব। [10]. মাসিক আত-তাহরীক, নভেম্বর-১৯৯৮, পৃঃ ২২। [11]. মাসিক আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর-২০০৪, পৃঃ ৯।

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button