প্রবন্ধ

যে সকল হারামকে মানুষ হালকা মনে করে (যিহার)

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যিনি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

মূল : মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

জাহেলী যুগ থেকে চলে আসা যা কিছু এই উম্মতের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে ‘যিহার’[1] তার একটি।

যেসব শব্দে যিহার হয় তার কতগুলি নিম্নরূপ:

স্বামী স্ত্রীকে বলবে, ‘তুমি আমার জন্য আমার মায়ের পৃষ্ঠতুল্য’। ‘আমার বোন যেমন আমার জন্য হারাম, তুমিও তেমনি আমার জন্য হারাম’। ‘তোমার এক চতুর্থাংশ আমার জন্য আমার ধাত্রীমায়ের মত হারাম’ ইত্যাদি।

যিহারের ফলে নারীরা ভীষণভাবে অত্যাচারিত হয়। যিহার একটি অমানবিক কাজ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

اَلَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْكُمْ مِنْ نِسَائِهِمْ مَا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلاَّ اللاَّئِي وَلَدْنَهُمْ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنْكَرًا مِنَ الْقَوْلِ وَزُورًا وَإِنَّ اللهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ

‘তোমাদের মধ্যে যারা নিজেদের স্ত্রীদের সঙ্গে যিহার করে তারা যেন জেনে রাখে যে, তারা তাদের মা নয়। তাদের মা তো তারাই যারা তাদের প্রসব করেছে। তারা তো কেবল অসঙ্গত ও মিথ্যা কথা বলে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মার্জনাকারী’ (মুজাদালাহ ২)

ইসলাম রামাযান মাসে দিনের বেলায় স্বেচ্ছায় সহবাসে ছিয়াম ভঙ্গের কাফফারা, ভুলক্রমে হত্যার কাফফারা যেভাবে দিতে বলেছে, যিহারের জন্যও ঠিক একইভাবে কাফফারা দিতে বলেছে। কাফফারা পরিশোধ না করা পর্যন্ত যিহারকারী স্ত্রীকে স্পর্শ করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,

وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنْ نِسَائِهِمْ ثُمَّ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا ذَلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ- فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَتَمَاسَّا فَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ذَلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَتِلْكَ حُدُودُ اللهِ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘যারা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে যিহার করে, তারপর তাদের উক্তি প্রত্যাহার করে নেয়, তাদের জন্য পারস্পরিক স্পর্শের পূর্বে একজন দাস মুক্তির বিধান দেয়া হল। এটা তোমাদের জন্য নির্দেশ। আর তোমরা যা কিছু কর তৎসম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। অনন্তর যে উহার সামর্থ্য রাখে না তাকে পারস্পরিক স্পর্শের পূর্বে একটানা দু’মাস ছিয়াম রাখতে হবে। যে তারও সামর্থ্য রাখে না তাকে ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে। এই বিধান এজন্য যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে তোমরা যেন ঈমান রাখ। এটা আল্লাহর সীমারেখা। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (মুজাদালা ৩-৪)

রাশিফল ও মানব জীবনের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব সম্পর্কিত বিশ্বাস

যায়েদ বিন খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হুদায়বিয়াতে এক রাতে আকাশে একটি চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। সেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফজর ছালাত শেষে লোকদের দিকে ফিরে বসেন এবং বলেন, ‘তোমাদের প্রতিপালক কি বলেছেন তা কি তোমরা জান’? তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, ‘আমার কিছু বান্দা আমার উপর বিশ্বাসী হয়ে এবং কিছু বান্দা অবিশ্বাসী হয়ে ভোরে ওঠে। যারা বলে, আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে বৃষ্টি হয়েছে তারা আমার প্রতি বিশ্বাসী ও গ্রহ-নক্ষত্রে অবিশ্বাসী। আর যারা বলে, অমুক অমুক গ্রহের প্রভাবে বৃষ্টি হয়েছে তারা আমার প্রতি অবিশ্বাসী ও গ্রহ-নক্ষত্রে বিশ্বাসী’।[1]

গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ার কথা বিশ্বাস করা যেমন কুফরী, তেমনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রাশিফলের আশ্রয় নেওয়াও কুফরী। যে ব্যক্তি রাশিফলের উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবের কথা বিশ্বাস করবে, সে সরাসরি মুশরিক হয়ে যাবে। পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তকে রাশিফলের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে সেগুলি পাঠ করা শিরক। তবে বিশ্বাস না করে কেবল মানসিক সান্ত্বনা অর্জনের জন্য পড়লে তাতে শিরক হবে না বটে, কিন্তু সে গোনাহগার হবে। কেননা শিরকী কোন কিছু পাঠ করে সান্ত্বনা লাভ করা বৈধ নয়। তাছাড়া শয়তান কর্তৃক তার মনে উক্ত বিশ্বাস জন্মিয়ে দিতে কতক্ষণ? তখন এ পড়াই তার শিরকের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে।

 


[1]. বুখারী হা/৮৪৬; মিশকাত হা/৪৫৯৬।

স্রষ্টা যেসব বস্ত্ততে যে কল্যাণ রাখেননি তাতে সে কল্যাণ থাকার আক্বীদা পোষণ করা 

আল্লাহ তা‘আলা এই বিশ্ব ও তার মধ্যস্থিত যাবতীয় বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তিনি যে কল্যাণ যে বস্ত্তর মধ্যে রাখেননি, ঐ বস্ত্ত সেই উপকারই করতে পারে বলে অনেকে বিশ্বাস করে। এরূপ বিশ্বাস শিরকের পর্যায়ভুক্ত। যেমন, বহু লোক তাবীয-তুমার, শিরকী ঝাড়-ফুঁক, বিভিন্ন প্রকার তাগা ও খনিজ পাথর ব্যবহার করে থাকে। তাদের বিশ্বাস, এতে রোগ-বালাই কাছে ভিড়তে পারে না। আর যদি রোগ হয়েই থাকে তবে এগুলি ব্যবহারে সুস্থতা ফিরে আসে। এগুলি ব্যবহারের পিছনে গণক, জাদুকর প্রমুখ শ্রেণীর পরামর্শ অথবা যুগ পরম্পরায় চলে আসা বিশ্বাস কাজ করে।

অনেকে বদ নযর এড়ানোর জন্য বাচ্চা ও বড়দের গলায় এসব ঝুলিয়ে দেয়, শরীরের অন্যত্রও বেঁধে রাখে (যেমন গলা, হাত ও কোমরে)। গাড়ী-বাড়ীতেও তাবীয ও দো‘আ-কালাম লিখিত কাগজ ঝুলিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে গাড়ী-বাড়ী দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যায় বলে তাদের বিশ্বাস।

অনেকে আবার রোগের হাত থেকে উদ্ধার পেতে কিংবা রোগ যাতে হতে না পারে সেজন্য কয়েক প্রকার ধাতু নির্মিত আংটি পরে থাকে (যেমন অষ্টধাতুর আংটি প্রভৃতি)। এর ফলে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভরতা হরাস পায় এবং হারাম জিনিস দ্বারা চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়।

এসব তাবীযের অনেকগুলিতেই স্পষ্ট শিরকী কথা, জিনের নিকট ফরিয়াদ, সূক্ষ্ম নকশা ও অবোধ্য কথা লেখা থাকে। অনেক জ্ঞানপাপী শিরকী মন্ত্রের সাথে কুরআনের আয়াত মিশিয়ে দেয়। কেউ কেউ নাপাক দ্রব্য, ঋতুস্রাবের রক্ত ইত্যাদি দিয়েও তাবীয লেখে। এ ধরনের তাবীয, তাগা, আংটি ঝুলানো কিংবা বাঁধা স্পষ্ট হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ ‘যে ব্যক্তি তাবীয লটকাল নিশ্চয়ই সে শিরক করল’।[1]

তাবীয ব্যবহারকারী যদি বিশ্বাস করে যে, এসব জিনিস আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়াই উপকার কিংবা অপকার করে, তাহলে সে বড় শিরক করার দোষে দুষ্ট হবে। আর যদি সে বিশ্বাস করে যে, এগুলি উপকার-অপকারের একটি উপকরণ মাত্র। অথচ আল্লাহ তা‘আলা এগুলিকে রোগ বিনাশ সংক্রান্ত কোন উপকার বা অপকারের উপকরণ করেননি, সেক্ষেত্রে সে ছোট গুনাহ করার দোষে দুষ্ট হবে। আর তখন এটি কারণ উদ্ভূত শিরকের (شرك الأسباب) পর্যায়ভুক্ত হবে।


[1]. আহমাদ হা/১৭৪৫৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৯২।

লোক দেখানো ইবাদত (الرياء)

আল্লাহ তা‘আলার নিকটে আমল কবুল হওয়ার জন্য রিয়া বা লৌকিকতা মুক্ত এবং কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত নিয়মে হওয়া অপরিহার্য। যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করবে, সে ছোট শিরক করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবে এবং তার আমল বরবাদ হয়ে যাবে। যেমন লোক দেখানো ছালাত। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন,إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلاَةِ قَامُوْا كُسَالَى يُرَآؤُوْنَ النَّاسَ وَلاَ يَذْكُرُونَ اللهَ إِلاَّ قَلِيْلاً ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করতে চায়। অথচ তিনিও তাদের সাথে প্রতারণা করতে সক্ষম। যখন তারা ছালাতে দাঁড়ায় তখন আলস্যভরে দাঁড়ায়। তারা লোকদের দেখায় যে তারা ছালাত আদায় করছে, কিন্তু আল্লাহকে তারা কমই স্মরণ করে’ (নিসা ১৪২)

স্বীয় কাজের কথা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ুক এবং লোকেরা শুনে বাহবা দিক এ নিয়তে যে কাজ করবে সে শিরকে নিপতিত হবে। এরূপ বাসনাকারী সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ وَمَنْ رَاءَى رَاءَى اللهُ بِهِ ‘যে ব্যক্তি মানুষকে শুনানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কিয়ামতের দিন) শুনিয়ে দিবেন। আর যে লোক দেখানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কিয়ামতের দিন) দেখিয়ে দিবেন’।[1] অর্থাৎ তিনি এসব লোককে কিয়ামতের দিন মানুষের সামনে অপমানিত করবেন এবং কঠোর শাস্তি দিবেন।

যে আল্লাহ ও মানুষ উভয়ের সন্তুষ্টিকল্পে ইবাদত করবে তার আমল বরবাদ হয়ে যাবে। হাদীছে কুদসীতে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন,

أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِى غَيْرِى تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ

‘আমি অংশীবাদিতা (শিরক) হতে সকল অংশীদারের তুলনায় বেশী মুখাপেক্ষীহীন। যে কেউ কোন আমল করে এবং তাতে অন্যকে আমার সাথে শরীক করে, আমি তাকে ও তার আমল উভয়কেই বর্জন করি’।[2]

তবে কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে কোন আমল শুরু করার পর যদি তার মধ্যে লোক দেখানো ভাব জাগ্রত হয় এবং সে তা ঘৃণা করে ও তা থেকে সরে আসতে চেষ্টা করে, তাহলে তার ঐ আমল শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি সে তা না করে; বরং লোক দেখানো ভাব মনে উদয় হওয়ার জন্য প্রশান্তি ও আনন্দ অনুভব করে, তাহলে অধিকাংশ আলিমের মতে তার ঐ আমল বাতিল হয়ে যাবে।

 


[1]. বুখারী হা/৬৪৯৯, মুসলিম হা/২৯৮৬; মিশকাত হা/৫৩১৬।

[2]. মুসলিম হা/২৯৮৫, মিশকাত হা/৫৩১৫।

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button