প্রবন্ধ

কুরবানির ইতিহাস

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যানি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

ওয়েব সম্পাদনাঃ ইসলামিকসেবা

কুরবানীর ইতিহাসঃ

মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ فَإِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا ۗ وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ [٢٢:٣٤]

প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা যবহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এজন্য যে, তিনি চতুষ্পদ গবাদি পশু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন। অনন্তর তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন। অতএব তার নিকটে তোমরা আত্মসমর্পণ কর এবং আপনি বিনয়ীদের সুসংবাদ প্রদান করুন”। (হজ্জঃ ৩৪)

আদম (আঃ) এর দুই পুত্র ক্বাবীল ও হাবীল এর দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মাতের উপর এটা জারি ছিল। তবে সেই সব কুরবানীর নিয়ম-কানুন আমাদেরকে জানানো হয়নি। মুসলিম উম্মাহর উপরে যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে।[১] যা মুক্বীম ও মুসাফির সর্বাবস্থায় পালনীয়। [২] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনার জীবনে দশ বছল নিয়মিত কুরবানী করেছেন।[৩]

ইবরাহীমী কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَىٰ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَىٰ ۚ قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ [٣٧:١٠٢فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ [٣٧:١٠٣]وَنَادَيْنَاهُ أَن يَا إِبْرَاهِيمُ [٣٧:١٠٤]قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ [٣٧:١٠٥إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ [٣٧:١٠٦]وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ [٣٧:١٠٧]سَلَامٌ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ [٣٧:١٠٩]

যখন সে (ইসমাঈল) তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল তখন তিনি (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে বৎস‍! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। অতএব বল, তোমার মতামত কি? ছেলে বলল, হে আব্বা! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা প্রতিপালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অতঃপর যখন পিতা ও পুত্র আত্মসমর্পন করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে ফেলল। তখন আমি তাকে ডাক দিলাম, হে ইবরাহীম! ‘ নিশ্চয়ই তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমি এমনিভাবে সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরষ্কৃত করে থাকি। নিশ্চই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদেরকে মধ্যে রেখে দিলাম। ইবরাহীমের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক”। ( সূরা ছাফফাতঃ ১০২-১০৯)

হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর ৮৬ বৎসর বয়সে ইসমাঈল বিবি হাজেরার গর্ভে এবং ৯৯ বছর বয়সে ইসহাক্ব বিবি সারাহর গর্ভে জন্মগ্রহন করেন। ইবরাহীম (আঃ) সর্বমোট ২০০ বছর বেঁচে ছিলেন।[৪]

ঘটনাঃ ফার্রা বলেন, যবহের সময় ইসমাঈলের বয়স ছিল ১৩ বছর। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, ঐ সময় তিনি কেবল সাবালকত্বে উপনীত হয়েছিলেন।[৫] এমন সময় পিতা ইবরাহীম স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি বৃদ্ধ বয়সের একমাএ সন্তান নয়নের পুত্তলি ইসমাঈলকে কুরবানী করেছেন। নবীদের স্বপ্ন ‘অহি’ হয়ে থাকে। তাদের চক্ষু মুদিত থাকলেও অন্তরচক্ষু খোলা থাকে। ইবরাহীম (আঃ) একই স্বপ্ন পরপর তিন রাত্রি দেখলেন। প্রথম রাতে তিনি স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে ভাবতে থাকেন, কি করবেন। এজন্য প্রথম রাতকে (৮ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুত তারবিয়াহ’ বা স্বপ্ন দেখানোর দিন, বলা হয়। দ্বিতীয় রাতে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখার পর তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশ হয়েছে। এজন্য এ দিনটি (৯ই যিলহাজ্জ ) ‘ইয়াউমু আরাফা’ বা ‘নিশ্চিত’ হওয়ার দিন’ বলা হয়। তৃতীয় দিনে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখায় তিন ছেলেকে কুরবানী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য এ দিনটিকে (১০ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুন নাহর’ বা কুরবানীর দিন বলা হয়। [৬]

এই সময় ইবরাহীম (আঃ) শয়তানকে তিন স্থানে তিনবার সাতটি করে পাথরের কংকর ছুঁড়ে মারেন। [৭] উক্ত সুন্নাত অনুসরণে উম্মাতে মুহাম্মাদীও হজ্জের সময় তিন জামরায় তিনবার শয়তানের বিরুদ্ধে কংকর নিক্ষপ করে থাকে এবং প্রতিবারে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষনা করে ‘আল্লাহ আকবার’ বলে থাকে।[৮]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে মুসনাদে আহমাদে।[৯] বর্ণিত হয়েছে যে, ইবরাহীম (আঃ) ছেলেকে কুরবানীর প্রস্তুতি নিলেন এবং তাকে মাটিতে উপুড় করে ফেলেন।

এমন সময় পিছন থেকে আওয়ায এলো;

يَا إِبْرَاهِيمُقَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا 

হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্ন সার্থক করেছ’। (ছফফাতঃ ১১০)

ইবরাহীম পিছন ফিরে দেখেন যে, একটি সুন্দর শিংওয়ালা ও চোখওয়ালা সাদা দুম্বা দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর তিনি সেটি মিনা প্রন্তরে (ছাবীর টীলার পাদদেশে) কুরবানী করেন।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন

“এজন্য আমরা কুরবানীর সময় অনুরুপ ছাগল-দুম্বা খুঁজে থাকি”[১০]

তিনি বলেন, ঐ দুম্বাটি ছিল হাবীলের কুরবানী, যা জান্নাতে ছিল, যাকে আল্লাহ ইসমাঈলের ফিদইয়া হিসাবে পাঠিয়েছিলেন।[১১]

ইবরাহীম উক্ত দুম্বাটি ছেলের ফিদইয়া হিসাবে কুরবানী করলেন ও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন “ হে পুত্র! আজই তোমাকে আমার জন্য দান করা হল”। [১২]

নিঃসন্দেহে এখানে মূল উদ্দশ্য যবহ ছিলনা, বরং উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও তাক্বওয়ার পরীক্ষা নেওয়া। সে পরীক্ষায় উভয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন পিতার পূর্ণ প্রস্তুতি এবং পুত্রের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ও আনুগত্যের মাধ্যমে।

কুরবানীর অনুমোদনের ব্যাপারে আল্লাহ তা‌’আলা বলেন।

﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ [الكوثر:2]

অতএব তোমরা রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড় এবং নহর কর। (কাউসার : ২)

তিনি আরো বলেন :

﴿ وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ [الحج:36]،

আর কুরবানীর উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি। (হজ : ৩৬)

কুরবানী সুন্নতে মুয়াক্কাদা। সামর্থ থাকা সত্বে তা ত্যাগ করা মাকরুহ। আনাস রাদিআল্লাহু আনহুর হাদীসে রয়েছে, যা বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। তারা বলেন :

أن النبي – صلى الله عليه وسلم – ضحى بكبشين أملحين أقرنين ذبحهما بيده وسمى وكبر.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরতাজা ও শিং ওয়ালা দুটি মেষ নিজ হাতে যবেহ করেছেন এবং তিনি তাতে বিসমিল্লাহ ও তাকবীর বলেছেন।

কুরবানীর পশুঃ উঠ,গরু ও বকরী ছাড়া কুরবানী শুদ্ধ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :

﴿ لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُم مِّن بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ [الحج:34].

যাতে তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে,যে সমস্ত জন্তু তিনি রিয্ক হিসেবে দিয়েছেন তার উপর। (হজ:৩৪)

[১] শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২২৮ পৃঃ।

[২] তাফসীরে কুরতুবী (বৈরুতঃ ১৪০৫/১৯৮৫)১৫/১০৯ পৃঃ নায়ল ৬/২৫৫ পৃঃ।

[৩] তিরমিযী, মিশকাত হা/১৪৭৫ ‘ছালাত অধ্যায়, কুরাবানী অনুচ্ছেদ।

[৪] তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৬; মুওয়াত্ত্বা, তাফসীরে কুরত্ববী ২/৯৮-৯৯ পৃঃ।

[৫] তাফসীরে কুরত্ববী ১৫/৯৯ পৃঃ।

[৬] তাফসীরে কুরত্ববী ১৫/১০২ পৃঃ।

[৭] তাফসীরে কুরত্ববী ১৫/১০৬ পৃঃ।

[৮] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/২৬৬১,২৬২৬ হজ্জ অধ্যায়।

[৯] মুসনাদে আহমাদ হা/২৭০৭, তাহক্বীক্ব; আহমাদ শাকির ১/২৯৭ পৃঃ; সনদ ছহীহ।

[১০] তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৭ পৃঃ; ঐ, তাহক্বীক্ব, সনদ ছহীহ ৭/২৮ পৃঃ।

[১১] তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।

[১২] তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button