পরিবার ও সমাজ

মানুষের সঙ্গে আপনার আচরণ কেমন হবে

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যানি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

লেখক: শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল-আরিফী | অনুবাদক: কাজী মুহাম্মদ হানিফ

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন গণিত শিক্ষক দেখলেন, তার ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্র ক্লাসে অমনােযােগী। পড়াশােনায়ও দুর্বল। এদিকে এরা আবার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তাই তিনি তাদের সংশােধন করতে চাইলেন।

হঠাৎ একদিন তিনি ক্লাসে এসে চেয়ারে বসতে না বসতেই বললেন, সবাই বই বন্ধ করে পাশে রাখ, খাতা-কলম হাতে নাও। ছাত্ররা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাে, ‘কেন স্যার? শিক্ষক বললেন, “আমি তােমাদের একটা সারপ্রাইজ পরীক্ষা নেব। ছাত্ররা বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করা সত্ত্বেও এক পর্যায়ে শিক্ষকের কথা মেনে নিল। তবে তাদের মধ্যে বিশাল দেহের অধিকারী কিন্তু মােটা মাথার এক ছাত্র ছিল।

অঘটন ঘটানাের ক্ষেত্রে সে ছিল খুব পটু। সে চিৎকার করে বললাে, স্যার! আমরা পরীক্ষা দেব না। রিভিশন দিয়ে পরীক্ষা দিতেই আমাদের বারােটা বেজে যায়। কিন্তু এখন রিভিশন ছাড়া পরীক্ষা দেব কীভাবে? ছাত্রটি কথাগুলাে এতাে কঠিন স্বরে বললাে যে, শিক্ষক রাগে ফেটে পড়লেন। শিক্ষক তাকে বললেন, এখানে তােমার খেয়াল খুশিমতাে কিছুই হবে না। আমি শিক্ষক আমার কথা তােমাকে মানতে হবে। না চাইলেও পরীক্ষা তােমাকে দিতেই হবে। বুঝতে পেরেছ? আর যদি পরীক্ষা দিতে ভাল না লাগে তাহলে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও।’ ছাত্রটিও ক্রোধে পাগলের মতাে বলে উঠল, “আমি যাব না; বরং আপনি ক্লাস হতে বের হয়ে যান। ছাত্রের মুখে এমন কথা শুনে শিক্ষক আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি বেয়াদব’, ‘অদ্র’ ইত্যাদি গালি দিতে দিতে তিনি ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলেন। এদিকে ছাত্রটিও রুখে দাঁড়াল। এরপর যা ঘটার, তাই ঘটল। শুধু এতটুকু বুঝে নিন যে, খুব খারাপ কিছু ঘটেছিল। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।

এ ঘটনার খবর কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছল। কর্তৃপক্ষ ছাত্রটিকে শাস্তি দিলেন। তার ফাইনাল পরীক্ষার মার্কশিটের গ্রেড দুই ধাপ নামিয়ে দেয়া হলাে এবং শিষ্টাচার বজায় রেখে চলার অঙ্গীকার করে তাকে একটি দরখাস্ত লিখতে বাধ্য করা হলাে। এদিকে ঐ শিক্ষক ‘টক অভ দ্যা স্কুলে পরিণত হলেন। স্কুলের সর্বত্র তাকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলাে। যার পাশ দিয়েই তিনি যান, সে-ই তাকে নিয়ে ফিসফিস করে আলােচনা করে। অনেকে তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য ছুড়ে দেয়। উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে তিনি অন্য বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে চলে যান। অন্য এক শিক্ষক একই ঘটনার মুখােমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি খুব কৌশলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি কিভাবে তা করেছিলেন? দেখুন, তিনিও একদিন ক্লাসে এসে ছাত্রদের বললেন, সবাই কাগজ কলম হাতে নাও। তােমাদের আজ সারপ্রাইজ পরীক্ষা হবে। তাদের মধ্য থেকে এক ছাত্র দাঁড়িয়ে বললাে, আপনি যখন যা চাইবেন তা-ই হবে এমন মনে করবেন না। আপনার ইচ্ছামতাে সব চলবে না। এ শিক্ষক ছিলেন খুব বিচক্ষণ।

তিনি মানুষের নাড়ি ও প্রকৃতি বুঝতেন। তিনি জানতেন গোঁয়ার্তুমি দিয়ে গোয়ারের মােকাবিলা করা যায় না। তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “ওহ আচ্ছা! খালেদ তুমি মনে হয় পরীক্ষা দিতে চাও না। ছাত্রটি চিৎকার করে বললাে, “অবশ্যই, আমি পরীক্ষা দেব না। শিক্ষক তখন খুব শান্তভাবে বললেন, ঠিক আছে, কোনাে সমস্যা নেই। যে পরীক্ষা দিতে চায় না, তার ব্যাপারে আমরা বিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবাে। ছেলেরা! তােমরা লেখ, প্রথম প্রশ্ন : নিচের সমীকরণটির সমাধান বের :… 15 +৫= ১০+ * এই বলে তিনি একের পর এক প্রশ্ন লেখাতে শুরু করলেন। গোঁয়ার ছাত্রটি আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না। সে চিৎকার করে বললাে, ‘আমি বলেছি, আমি পরীক্ষা দেব না।’ শিক্ষক শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, আমি কি তােমাকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছি? তুমি স্বাধীন মানুষ । তুমি যেমন করবে, তেমন ফল পাবে।’ শিক্ষকের এ কথার পর ছাত্রটি তাকে রাগানাের মতাে আর কিছু খুঁজে পেল।

অবশেষে সে শান্ত হয়ে কাগজ কলম বের করলাে এবং সহপাঠীদের সঙ্গে প্রশ্ন লিখতে শুরু করলাে। পরবর্তীতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকের সাথে তার অসদাচরণের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিল।

কাল্পনিক এই ঘটনা দুটি থেকে আপনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার যােগ্যতা সবার এক রকম নয়। কেউ পরিস্থিতিকে উত্তাল করে তােলে, আবার কেউ দ্রুত তা শান্ত করে ফেলতে পারে। গোঁয়ার ব্যক্তির সঙ্গে গোঁয়ার্তুমি করলে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, আগুনের মােকাবিলা আগুন দ্বারা করা হলে উত্তাপ ও লেলিহান শিখাই বাড়তে থাকবে। অপরদিকে ঠাণ্ডার সঙ্গে সবসময় ঠাণ্ডা ব্যবহার করলে কোনাে কাজই ঠিক থাকবে না।

সুতরাং মানুষের সঙ্গে আপনার আচরণ কেমন হবে, তা বুঝতে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সুতা দর্শনের শরণাপন্ন হতে পারেন।

মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি গভর্নর হিসেবে বিশ বছর এবং খলিফা হিসেবে বিশ বছর এত দীর্ঘ সময় কীভাবে শাসন করলেন? মুয়াবিয়া বলেছিলেন, ‘আমি জনগণ ও আমার মধ্যে একটি সুতা রেখেছি। সুতার এক প্রান্ত আমার হাতে, অপর প্রান্ত জনগণের হাতে। তারা যখন সুতা ধরে টান দেয় তখন আমি ঢিল দেই, যেন সুতাটা ছিড়ে না যায়। আর যখন জনগণ ঢিল দেয় তখন আমি টেনে ধরি। মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সত্য বলেছেন। মানুষের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে এটি একটি যথার্থ উক্তি। কত চমৎকার ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা! দাম্পত্য জীবনে স্বামী স্ত্রী উভয়ই যদি গোঁয়ার হয়, কেউ কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতে না চায় তাহলে তাদের সংসারে কখনাে সুখ আসবে।

অনুরূপ দুই পার্টনারের উভয়ে যদি একগুঁয়ে প্রকৃতির হয় তাহলে তাদের অংশিদারিত্ব বেশি দিন টিকবে না। একবার আমি এক জেলখানায় ধর্মীয় আলােচনা করেছিলাম। ঘটনাক্রমে আমার আলােচনাটি ছিল জেলখানার সে অংশে যেখানে খুনের আসামীদেরকে রাখা হতাে। আমি যখন আলােচনা শেষ করলাম তখন কয়েদীরা সবাই নিজ নিজ সেলে ফিরে গেল । কিন্তু তাদের একজন এগিয়ে এসে আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। তিনি জেলখানায় বিভিন্ন বিনােদনমূলক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এদের অধিকাংশের হত্যার মতাে অপরাধ সংঘটনের পেছনে কারণ কী? তিনি বললেন, ‘রাগ ও ক্রোধই হলাে মূল কারণ। এদের কেউ কেউ সামান্য কিছু টাকার জন্য সেলসম্যানের সঙ্গে ঝগড়া করে উত্তেজিত হয়ে কিংবা ফিলিং স্টেশনের কর্মচারীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তখন আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি হাদিস মনে পড়ে গেল ও ‘কাউকে ধরাশায়ী করতে পারা বীরত্ব নয়। প্রকৃত বীর তাে সে-ই, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’ (সহীহ বুখারী: ৫৬৪৯, সহীহ মুসলিম: ৪৭২৩)

কিন্তু যুবকটি তার গাড়ির গতি আরাে কমিয়ে দিল এবং হাত নেড়ে পেছনের গাড়িটিরও গতি কমাতে বললাে। পেছনের গাড়ির চালক খুব বেশি সময় ধৈর্য ধরতে পারল না। সে বিরক্ত হয়ে সাইড দিয়ে ওভারটেক করে চলে গেল। তবে কোনাে গাড়িরই কোনাে ক্ষতি হলাে না। তবে এটা দেখে যুবকটির মাথা গরম হয়ে গেল। অবশ্য এর চেয়ে তুচ্ছ কিছু ঘটনায়ও সে প্রচণ্ড রেগে যায়। সেও তাদের ধরার জন্য গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল এবং বারবার তাদেরকে থামার জন্য সিগনাল দিতে লাগল। এ অবস্থা দেখে সামনের গাড়িটি থামল। তখন যুবকটি তার মাথার রুমাল খুলে সিটের পাশে রেখে একটি রড (নাটবন্দু খােলার যন্ত্রবিশেষ, বড় রেঞ্চ) হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলাে। তার চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছিল। এ অবস্থায় সে সামনের গাড়ির যাত্রীদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনের গাড়ি থেকে তিনজন যুবক নেমে আসল।

যুবকদের প্রত্যেকেই ছিল পেশিবহুল ও সুগঠিত দেহের অধিকারী। তাদের পেশী যেন তাদের পরিধেয় কাপড় ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে! যুবকরা তার দিকে তেড়ে আসছিল। তারা তার হাতে রডটি দেখে তার মনােভাব বুঝতে পেরেছিল । তাই তারাও প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসছিল। এটা দেখে যুবকটি খুব ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলাে। সঙ্গে সঙ্গে সে রডটা উচু করে ধরে বললাে, “সরি, এটা আপনাদের গাড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। এটা আপনাদের কাছে ফেরত দিতে এসেছি।’ তিনজনের একজন শান্তভাবে তার হাত থেকে রডটা নিয়ে গাড়িতে উঠে। চলে গেল। আর সে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।

সমীকরণ … গোঁয়ার + গোঁয়ার = বিস্ফোরণ !

উৎসঃ Enjoy Your Life (Bangla Version), অধ্যায়ঃ ২১, পৃষ্ঠা: ১৪২ – ১৪৭

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button