রামাযান ও সিয়াম

রমজান বিদায় হতে চলল কিন্তু আমাদের খবর কী?…

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যানি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

রমজান চলে গেল : কিন্তু আমাদের খবর কী?…

রমজান বদায় হতে চলল কিন্তু আমাদের খবর কী?

রমজান চলে গেল:কিন্তু আমাদের কি খবর?…

মাহে রমজানে সাধারণ মুসলমানের দ্বীনের প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখে অন্তরে খুশি বন্যা বয়ে যায়। কারণ যে দিকে চোখ ফিরায় সেদিকেই দেখে নেক আমলের ঢল। মনে হয় ইসলামের জয় জয়কার।

কিন্তু…?

ঈদ ও তার পরবর্তী দিনগুলো উক্ত সুধারণার সত্যায়ন করে, অথবা সব ধারণা গুণাহমিশ্রিত আনন্দে ভেস্তে যায়।

যে ব্যক্তি মাহে রমজান ও রমজান পরবর্তী মানুষের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করবে তখন সে আশ্চর্য না হয়ে পারবে না। কেননা রমজানের পর লোকজন ইবাদতে অলসতা বরং ইবাদত থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। মনে হয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে- ইবাদত, তওবা ও সকল নেক আমল শুধুমাত্র মাহে রমজানের সাথেই সম্পৃক্ত। তারা এ কথা জানেনা যে, আল্লাহ তাআলা রমজান সহ সবকয়টি মাসের রব। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান হলো আনুগত্য ও ধৈর্যের অনুশীলন মাত্র। এ মাসে ঈমানি শক্তি সঞ্চয় করে বাকি এগার মাস চলতে হবে।

হ্যাঁ, তবে রমজান মাসে ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব আছে এবং রমজান অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু রমজান মাসই কেবল ইবাদতের জন্য খাস নয়। আর এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময়ই দান-সদকা করতেন, তবে রমজানে তার দানের পরিমাণ অন্যান্য মাসের তুলনায় বেড়ে যেত। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে এই দুআ পাঠ করে আশ্রয় চেয়েছেন-

{ وأعوذ بك من الحور بعد الكور }

অর্থাৎ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি …

পবিত্র কালামে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,

﴿وَلاَ تَكُونُواْ كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِن بَعْدِ قُوَّةٍ أَنكَاثًا﴾[النحل:92]

তোমরা ঐ নারীর মত হয়োনা, যে সুতা দিয়ে মজবুতভাবে কাপড় তৈরি করার পর সুতাগুলো কাটতে শুরু করল। (সূরা নহল : ৯২)

অতএব, কল্যাণমূলক কাজগুলো কেবল রমজানের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময়ই আমাদের রবের ডাকে সাড়া দিতে হবে। এরশাদ হচ্ছে –

﴿وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ﴾[الحجر:99]

মৃত্যু আসার পূর্ব পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদতে নিয়োজিত থাক। (সূরা হিজর : ৯৯)

অতএব, মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহ ইবাদত ও নৈকট্য অর্জনের সমাপ্তি নেই।

ঈদে মানুষের বৈধ-অবৈধ পন্থায় আনন্দ-উল্লাস ও শরীয়তের সীমালঙ্ঘনের প্রতি দৃষ্টি দিলে মনে হবে না যে, তারা তাদের রমজানের নেক আমলগুলো প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে ভয় করছে, অথবা যে ঈদের মাধ্যমে আল্লাহ তাদের সম্মান দান করেছেন তার ব্যাপারে তারা শুকরিয়া আদায় করছে। আর এ কারণেই তাদের অবস্থা ঐ নারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে যে সুতা বুনার পর তা কেটে ফেলে।

মানব প্রকৃতি হলো যদি সে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যাস্ত থাকে তাহলে কখনো সে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এমন কোন কাজে লিপ্ত হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন :

﴿إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَى لَهُم﴾[محمد:25]،

নিশ্চয় যারা হেদায়েত স্পষ্ট হওয়ার পর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে শয়তান তাদের প্ররোচিত করে এবং আশা দেয়। (সূরা মুহাম্মদ : ২৫)

আসলে যদি তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যকে ভালোবাসত তাহলে চোখের এক পলকের জন্যও তা থেকে দূরে থাকত না।

শুনে রাখুন, কেউ অলস ও দুর্বল হয়ে গেলে কিন্তু সাধনা করতে পারবে না। আর যদি কেউ তারাবি নামাজ নিয়ে গর্ব করে তাহলে নিজে নিজে শেষ হেয় যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নিজেকে ইবাদাত ও দৃঢ়তার উপর সংযত রাখা, কঠিনভাবে নিজেকে ইবাদতে আটকে রাখা।

হে মুসলমান, খবরদার! রমজানে কুপ্রবৃত্তি দমন করে ধোকায় পড়োনা, তাতে তুমি রমজানের পর আবার ফিতনায় জড়িয়ে পড়বে। কেননা কুপ্রবৃত্তি মানুষকে চক্রান্তে ফেলে দেয়। যুদ্ধের ময়দানে এমন অনেক বীর পুরুষ ধোকায় পড়ে, ফলে সে এমন এক পরিস্থিতির শিকার হয়, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। এখানে হামযা রা. এর সাথে ওয়াহশির ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হতে পারে। যে ব্যক্তি আমল করে কিছদূর গিয়ে আবার অলস হয়ে স্থির হয়ে যায় সে ব্যক্তি কখনো শান্তি পায় না। কেননা প্রবাদ বাক্যে বলা হয়-

إن أردت ألا تتعب فاتعب لئلا تتعب

যদি তুমি ক্লান্ত হতে না চাও তাহলে তুমি করতে থাক, যাতে তুমি ক্লান্ত না হও।

এক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার বাণী সবচেয়ে অর্থবহ, এরশাদ হচ্ছে-

{فَإِذَا فَرَغْتَ فَانصَبْ﴾ [الشرح:7]،

অত:পর তুমি যখন ফারেগ হবে, তখন তুমি নামাজে দাড়িয়ে যাও। (সূরা ইনশিরাহ : ৭)

কেননা অলসতা কখনো কারো হক আদায় করতে পারে না। যে ব্যক্তি হায় হুতাশ করে সে কখনো হকের উপর অটল থাকতে পারে না। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

والكيس من دان نفسه وعمل لما بعد الموت والعاجز من أتبع نفسه هواها وتمنى على الله الأماني.

যে ব্যক্তি নফসকে কন্ট্রোল করে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য আমল করে সে-ই প্রকৃত বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি নিজের নফসের অনুসরণ করে ও আল্লাহর উপর ভরসা কের সে-ইঅক্ষম।

নফসকে শাসন করার মূলমন্ত্র হলো আমলের প্রতি দৃঢ় সংকল্প করা। কেননা সংশয়ের কারণেই কোন কাজ ধ্বংস হয়ে যায়।

মুজাহাদা একটি আশ্চর্যজনক পদক্ষেপ। তাইতো দেখা যায় যারা নফসকে যা ইচ্ছা তা-ই করার জন্য ছেড়ে দেয়, নফস তাদেরকে অপছন্দনীয় কর্মকান্ডে ফেলে দেয়। আর যারা সর্বদা নফসের বিরোধিতা করে তাদের নফস কষ্ট পেলেও তারা সফল হয়ে যায়। আরবি কবি যথার্থই বলেছেন _

والنفس كالطفل إن تهمله شب على- حب الرضاع وإن تفطمه ينفطم

নফস হলো ছোট্ট শিশুর মত, তাকে ছেড়ে দিলে সে দুধ পান করার জন্য উদগ্রীব থাকে, আর তাকে দুধ পান ছাড়িয়ে ফেললে ছেড়ে দেয়।

একথা সত্য যে দুনিয়ার জীবন কষ্ট-ক্লেশ থেকে কখনো পৃথক হয় না। জীবন চলার পথে অনেক মুসীবতের সম্মুখীন হতে হয়। মানব জীবনে সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো পরিণতি সম্পর্কে অনুভূতি না থাকা। বরং এর চেয়েও নিকৃষ্ট হলো পূর্ণমাত্রায় ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত হওয়ার পর ইবাদত কমিয়ে দিয়ে তার উপর সন্তুষ্ট থাকা, অথবা গুণাহ থেকে তওবা করে আবার গুণাহে ফিরে আসা। যার অবস্থা এমন সে কখনো ইবাদত করে কামিয়াব হতে পারে না। যদি কেউ মৌসুমী ইবাদতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে তাহলে সে কঠিন শাস্তিতে নিমজ্জিত হবে, আর তা হলো ইবাদতের মজা ও আল্লাহর সাথে নিবির মুনাজাতের মিষ্টতা আস্বাদন করার সুযোগ না পাওয়া। মুমিন নারী ও পুরুষ যারা প্রতিটি মাসের রবের ইবাদত করে প্রত্যেক মাসে, তাদের বাহির ও ভিতর সমান। তাদের শাওয়াল মাস রমজানের মতই।

মানুষকে কষ্ট ক্লেশের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ তার রব পর্যন্ত পৌঁছতে কঠোর পরিশ্রম করবে। অত:পর তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। নেক আমল নিয়মতান্ত্রিক করার ব্যাপারে মুসলমানকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে তা হলো সাধ্যের বাইরে কোন কাজ শুরু না করা। সুক্ষভাবে চিন্তা করে আমল শুরু করতে হবে। কঠিন পথ যথাসম্ভব ধীর স্থিরতার সাথে অতিক্রম করতে হবে। কাজ করার জন্য বিশ্রাম গ্রহণও কাজ করার শামিল। মণি মুক্তা অন্বেষণে সমুদ্রে ডুব দেয়া উপরে উঠারই নামান্তর। সহজ পন্থায় নেক আমল করার উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি এরশাদ করেন-

{ إن هذا الدين متين فأوغلوا فيه برفق }

নিশ্চয় এ দ্বীন বড় শক্ত। অতএব, তাতে তোমরা নম্রভাবে প্রবেশ কর।

বুখারীর বর্ণনায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন :

{ إن الدين يسر ولن يشاد الدين أحد إلا غلبه }.

নিশ্চয় দ্বীন বড় সহজ, যে ব্যক্তি দ্বীনকে কঠিনভাবে নেবে তার বেলায়ই দ্বীন কঠিনভাবে আরোপিত হবে

অল্প আমল নিয়মিত করার মাঝে বরকত আছে। এটি আল্লাহ তাআলা খুব পছন্দ করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

{ يا أيها الناس خذوا من الأعمال ما تطيقون فإن الله لايمل حتى تملوا وإن أحب الأعمال إلى الله مادام وإن قل }

হে লোক সকল! তোমরা যতটুকু আমল নিয়মিত করতে পারবে তা-ই গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তাআলা প্রতিদান দিতে বিরক্ত হন না, বরং তোমরাই বিরক্ত হয়ে যাও। নিশ্চয় আল্লাহর নিকট প্রিয় আমল হলো যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।

তবে আমল নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার অর্থ আবার এই নয় যে, অবহেলা করে আমল ছেড়ে দেবে। বরং এর উদ্দেশ্য হলো মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে আমল চালিয়ে যাওয়া। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা. বলেন : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেন :

{ يا عبدالله لا تكن مثل فلان كان يقوم الليل فترك قيام الليل }.

হে আব্দুল্লাহ তুমি অমুক ব্যক্তির মত হয়োনা, যে রাত জেগে ইবাদতের অভ্যাস করে আবার তা ছেড়ে দিল।

আল্লাহ তাআলা মৃত্যু আসার পূর্ব পর্যন্ত নেক আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর নবীকে। এরশাদ হচ্ছে-

﴿وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ﴾[الحجر:99].

আর তুমি তোমার রবের ইবাদত কর, তোমার নিকট মৃত্যু আসার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত। (সূরা হিজর : ৯৯)

তাই আসুন আমরা সবাই আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হই। এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাতে অটল থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমীন।

সমাপ্ত

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button