কিয়ামতের পূর্বে অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে
প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেনা
শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যিনি পরম করুনাময়, অতি দয়ালু।
কিয়ামতের পূর্বে অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবেঃ
ফিতনা শব্দটি বিপদাপদ, বিশৃংখলা, পরীক্ষা করা ইত্যাতি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। অতঃপর শব্দটি প্রতিটি অপছন্দনীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। নবী (ছাঃ) বলেছেনঃ
“ এই উম্মাতের প্রথম যুগের মুমিনদেরকে ফিতনা থকে হেফাজতে রাখা হয়েছে। আখেরী যামানায় এই উম্মতকে বিভিন্ন ধরনের ফিতনায় ও বিপদে ফেলে পরীক্ষা করা হবে। প্রবৃত্তিরি অনুসরণ ফির্কাবন্দী এবং দলাদলির কারণে ফিতনার সূচনা হবে। এতে সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যাবে এবং ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে। একে অপরের উপর তলোয়ার উঠাবে। ব্যাপক রক্তপাত ও প্রাণ হানি ঘটবে। নবী (ছাঃ) সকল ফিতনা সম্পর্কে উম্মাতকে সাবধান করেছেন এবং তা থেকে বাঁচার উপায়ও বলে দিয়েছেন। আমর বিন আখতাব (রাঃ) বলেনঃ একদা নবী (ছাঃ) আমাদেরকে নিয়ে ফজর নামায পড়লেন। অতঃপর মিম্বারে উঠে যোহর নামায পর্যন্ত ভাষণ দিলেন। যোহর নামায আদায় করে পুনরায় ভাষণ শুরু করে আসর নামায পর্যন্ত ভাষণ দান করলেন। অতঃপর আসর নামায শেষে ভাষণ শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ভাষণ দিলেন। এই দীর্ঘ ভাষণে তিনি কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত যা হবে সবই বলে দিয়েছেন। আমাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে জ্ঞানী তরাই এগুলো মুখস্থ রেখেছেন”। (মুসলুম, অধ্যায়ঃ কিতবুল ফিতান)
ফিতনাগুলো একটি অপরটির চেয়ে ভয়াবহ হবে। এমনকি ফিতনায় পড়ে মানুষ দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে। নবী (ছাঃ) বলেনঃ
اءِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ فِتَتًا قَنَّهاَ فِطَعُ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّ جُلُفِيهاَ مُوءْمِنًا َوَيُمْسيِ كَفِرًا وَيَبِيعُ فِيهَا أقْوَامٌ خَلَقَهُمْ بِعَرَ ضٍ مِنَ الدُّنْيَا
“নিশ্চয়ই কিয়ামতের পূর্বে অন্ধকার রাত্রির মত ঘন কালো অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। সকালে একজন লোক মু’মিন অবস্থায় ঘুম থেকে জাগ্রত হবে। বিকালে সে কাফেরে পনিণত হবে। বহু সংখ্যক লোক ফিতনায় পড়ে দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে তাদের চরিএ ও আদর্শ বিক্র করে দিবে। (মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান)
অপর বর্ণনায় এসেছে, “তোমাদের একজন দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময়ে তার দ্বীন বিক্র করে দিবে”। (তিরমিজী, ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেনঃ সহীহুল জামে আস্ সাগীর হাদীছ নং৫১২৫)
ফিতনার কতিপয় দৃষ্টান্তঃ
নবী (ছাঃ) যে সমস্ত ফিতনার সংবাদ দিয়েছেন তার মধ্যে উছমান (রাঃ) এর হত্যাকান্ড একটি অন্যতম ভয়াবহ ফিতনা। এখান থেকেই মুসলিম উম্মার ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হয়।একদল অপর দলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। প্রচুর রক্তপাত ঘটানো হয় এবং উভয় পক্ষের অনেক লোক নিহত হয় । হুজায়ফা (রাঃ) এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি একদা উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) এর কাছে বসা ছিলেন। উমার (রাঃ) বললেনঃ “তোমাদের মধ্যে কে নবী (ছাঃ) হতে বর্ণিত ফিতনার হাদীছ মুখস্থ রেখেছে? হুজায়ফা (রাঃ) বললেনঃ মানুষ ধন- সম্পদ, স্ত্রী-পরিবার ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে ফিতনায় পড়ে যে গুনাহর কাজে লিপ্ত হবে নামায, সাদকাহ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ এবং অন্যান্য সৎকাজ তা মিটিয়ে দিবে। উমার (রাঃ) বললেনঃ আমি আপনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করছিনা। আপনাকে সে ফিতনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছি, যা সাগরের ঢেউয়ের মত আসতে থাকবে। হুজায়ফা (রাঃ) বললেনঃ হে আমীরুল মু’মিনিন! এ রকম ফিতনায় আপনি পতিত হবেন না। কারণ আপনার মাঝে এবং ফিতনার মাঝে একটি বন্ধ দরজা রয়েছে। উমার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ সেই দরজাটি খুলে দেয়া হবে? না কি বল প্রয়োগ করে ভেঙ্গে ফেলা হবে? হুজায়ফা (রাঃ) বললেনঃ বরং তা ভেঙ্গে ফেলা হবে। উমার (রাঃ) বললেন, তাই যদি হয় আর কোন দিন তা বন্ধ করা সম্ভব হবেনা। হুজায়ফা (রাঃ) বললেনঃ আমি বললামঃ হ্যাঁ, তাই। সাহাবীগণ বলেনঃ আমরা হুজায়ফাকে জিজ্ঞেস করলামঃ উমার (রাঃ) কি জানতেন সেই বন্ধ দরজা কোনটি? তিনি বললেনঃ দিনের পর রাত্রির আগমণ যেমন নিশ্চিত তেমনি নিশ্চিতভাবেই তিনি তা জানতেন। হদীছের শেষাংশে এসেছে সেই বন্ধ দরজাটি ছিলেন উমার (রাঃ) স্বয়ং নিজেই”। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।)
উপরের হাদীছের সারমর্ম এই যে, উমার (রাঃ) এর শাহাদতের পরই ফিতনা শুরু হবে। কিয়ামতের পূর্বে তা আর বন্ধ হবেনা। ফিতনার কবলে পড়ে উছমান (রাঃ) নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। এই হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করেই আলী (রাঃ) এবং মুআবীয়ার মাঝে অনেক সংঘর্ষ হয়েছে এববং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে।
উষ্ট্রের যুদ্ধঃ
উছমান বিন আফফান (রাঃ) শহীদ হওয়ার পর উস্ট্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উছমান (রাঃ) এর হত্যাকে কেন্দ্র করে ভুল বুঝাবুঝিই এই যুদ্ধের মূল কারণ। এই যুদ্ধের এক পক্ষে ছিলেন আলী (রাঃ) এবং অপর পক্ষে ছিলেন আয়েশা, (রাঃ) তালহা এবং যুবায়ের (রাঃ)। যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আসলে উদ্দশ্য নয়। এখানে যে কথাটি হচ্ছে তা হলো কোন পক্ষেরই যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য ছিলনা। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেনঃ আয়েশা (রাঃ) যুদ্ধের জন্য বের হননি। তিনি উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসার জন্যে বের হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর বের হওয়ার মধ্যেই মুসলিম উম্মাতের জন্য কল্যান রয়েছে। অতঃপর তিনি বুঝতে সক্ষম হলেন যে, বের না হওয়াটাই ছিল ভাল। তাই তিনি যখনই বের হওয়ার কথা স্মরণ করতেন তখন কেঁদে ওড়না ভিজিয়ে ফেলতেন। এমনিভাবে যারাই আলী (রাঃ) এবং মুআবিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন তাঁদের সবাই পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়েছেন। আয়েশা (রাঃ) এর বের হওয়া সম্পর্কে নবী (ছাঃ) ভবিষ্যৎ বাণী করে গিয়েছিলেন। বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আয়েশা (রাঃ) বনী আমেরের বাড়ি-ঘরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন তখন তাকে দেখে কতগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ করা শুরু করল। তিনি বললেনঃ এই জলাশয়টির নাম কি? লোকেরা বললোঃ এটির নাম ‘হাও- আব’। একথা শুনে আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ আমার ফেরত যেতে ইচ্ছে করছে। যুবায়ের (রাঃ) তাকে বললেনঃ অগ্রসর হোন! যাতে মানুষেরা আপনাকে দেখতে পায় এবং হতে পারে আল্লাহ তা’আলা আপনার মাধ্যমে তাদের মাঝে মীমাংসা করে দিবেন। তিনি পুনরায় বললেনঃ মনে হচ্ছে আমার ফেরত যাওয়া উচিত। কেননা আমি রাসূল (ছাঃ) কে বলতে শুনেছি, তিনি আমাদেরকে (নবী পত্নীদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ
“ কেমন হবে তখনকার অবস্থা যখন তোমাদের কাউকে দেখে হাও-আবের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করবে?”। (মুস্তাদরাকুল হাকীম। ইমাম ইবনে হজার (রঃ) বলেনঃ হাদীছের সনদটি বুখারীর শর্ত অনুযায়ী, ফাতহুল বারী,(১২/৫৫)
আয়েশা (রাঃ) নবী (ছাঃ) এর বানীটি মুখস্থ রেখেছিলেন। তিনি যখন ইরাকের বসরা শহরের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলেন তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে নবী (ছাঃ) এর ভবিষ্যৎ বাণীটি স্মরণ করে জিজ্ঞেস করলেন এটি কোন জলাশয়? লোকেরা বললঃ এটি হাও-আবের জলাশয়। এই কথা শুনে তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে সক্ষম হলেন যে তিনি ফিতনায় পড়ে গেছেন এবং বার বার ফেরত আসার চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে তিনি নিরাপদে মদীনায় ফেরত আসলেন। তিনি নিজেও যুদ্ধ করেন নি এবং কাউকে যুদ্ধের আদেশও দেন নি।
সিফফীনের ফিতনাঃ
নবী (ছাঃ) বলেনঃ
لَ تَقُو مُ السَّا عَةُ َحَتَّى تَقْتَتِلَ فِءَتَانِ عَظِيمَتَانِ يَكُونُ بَنَهُمَ مَقْطَلَةٌ عَظِيمَةٌ دَعْوَتُهُمَ وَاحِدَةٌ
“ আমার উম্মতের দু’টি বিশাল দল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠত হবেনা। তাদের মাঝে ভয়াবহ যুদ্ধ হবে। কিন্তু উভয়ের দাবী হবে একটাই”। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান)
একানে দুইটি দল বলতে আলী (রাঃ) ও মুআবিয়া (রাঃ) এর দলকে বুঝানো হয়েছে। হিজরী ৩৬ সালে ইরাকের ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত সিফফীন নামক স্থানে এই দল দু’টি পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আলী ও মুআবিয়া (রাঃ) এর মাঝে যে সমস্ত যুদ্ধ হয়েছে তার কোন একটিও তাদের ইচ্ছায় হয়নি; বরং উভয় দলের মধ্যে কিছু পথভ্রষ্ট, কুপ্রবৃত্তির অনুসারী এবং কুচক্রী লোক ছিল। তরা সদাসর্বদাই মানুষকে যুদ্ধের প্রতি উস্কানি দিতে থাকে। এতে করে বিষয়টি উভয়ের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।
মন্তব্য করুন