প্রবন্ধ

জাকাতের গুরুত্ব, ফজিলত ও ব্যয়ের খাতসমূহ

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যিনি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

লেখক : জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের সম্পাদনা : আলী হাসান তৈয়ব

জাকাত এর সংজ্ঞা: 
জাকাত শব্দের অর্থ শুচিতা ও পবিত্রতা, শুদ্ধি ও বৃদ্ধি।
পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরিয়ত নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ কুরআনে বর্ণিত আট প্রকারের কোন এক প্রকার লোক অথবা প্রত্যেককে দান করে মালিক বানিয়ে দেয়াকে জাকাত বলে।
জাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
জাকাত ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে একটি। জাকাত ছাড়া দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করে না। যারা জাকাত অস্বীকার করে তাদের হত্যা করা হবে। এবং যারা জাকাতের ফরয অস্বীকার করে তাদের কাফের বলে গণ্য করা হবে। এই জাকাত ফরয করা হয় ২য় হিজরীতে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারিমের বহু জায়গায় ইরশাদ করেছেন,
‏(‏وأقيموا الصلاة وآتوا الزكاة واركعوا مع الراكعين‏ ‏‏)البقرة:‏ ৪৩)‏ 
‘আর তোমরা নামায কায়েম কর, জাকাত আদায় করো এবং রুকু কর রুকুকারীদের সঙ্গে।’ (সূরা বাকারা : ৪৩)
‏ ‏(‏والذين في أموالهم حق معلوم للسائل والمحروم‏)‏ ‏ ‏‏المعارج ‏২৪‏‏‏/‏‏২৫)
‘আর যাদের ধন সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক এবং বঞ্চিতদের জন্য নির্দিষ্ট অধিকার।’
এই পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামায এবং রোজার সম্পর্ক মানুষের দৈহিক পরিশ্রম ও মনের সাথে সম্পৃক্ত, পক্ষান্তরে জাকাত ও হজ্বের সম্পর্ক অর্থের সাথেও রয়েছে। বিশেষভাবে জাকাত ধনী বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ওপরই ফরয হয়ে থাকে। হাদিস শরিফে আছে,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
تؤخذ من أغنيائهم وترد على فقرائهم ، البخاري: ১৪০১
‘তাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে গ্রহণ করা হবে। আর তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র বা অভাবী তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।

ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। একজনের হাতে বিপুল অর্থ-সম্পদ জমা হওয়াকে ইসলাম পছন্দ করে না। ইসলাম চায় ধনী-গরিব সবাই স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করুক। তাই দরিদ্রের প্রতি লক্ষ্য করে জাকাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। হাদিসের ভাণ্ডারে সংরক্ষিত হয়েছে জাকাতের বিশেষ গুরুত্ব সংবলিত অনেক হাদিস।

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয়- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল আর নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত আদায় করে।’ (বুখারি, মুসলিম) 
জারির ইবনে আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-
‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করি নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনার ওপর। (বুখারি, মুসলিম)
আবু সায়ীদ রা. বর্ণনা করেন,
‘একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নসিহত করছিলেন। তিন বার শপথ করে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, রমযানের রোযা রাখবে, জাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য অবশ্যই বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ কর’।’ (নাসায়ী: ২৩৯৫)
আবুদ্দারদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘তোমরা নিজেদের মালের জাকাত প্রদান করে তা হিফাজত কর আর সদকা দিয়ে রোগীদের রোগ আরোগ্য কর।’
যারা জাকাত আদায় করে না তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির সংবাদ এসেছে:
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
ولا يحسبن الذين يبخلون بما ءاتاهم الله من فضله هو خيراً لهم بل هو شر لهم سيطوقون ما بخلوا به يوم القيامة ولله ميراث السموات والأرض والله بما تعملون خبير { [ آل عمران : ১৮০ ] 
অন্যত্র ইরশাদ করেন-
والذين يكنزون الذهب والفضة ولا ينفقونها في سبيل الله فبشرهم بعذاب أليم (৩৪) يوم يحمى عليها في نار جهنم فتكوى بها جباههم وجنوبهم وظهورهم هذا ما كنزتم لأنفسكم فذوقوا ما كنتم تكنزون { [ التوبة : ৩৪، ৩৫] 
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
 ما من صاحب ذهب ولا فضة لا يؤدي حقها إلا إذا كان يوم القيامة صفحت له صفائح من نار فأحمي عليها في نار جهنم ، فيكوى بها جنبه وجبينه وظهره ، كلما بردت أٌعيدت في يوم كان مقداره خمسين ألف سنة ، حتى يقضى بين العباد، فيرى سبيله، إما إلى الجنة وإما إلى النار 
‘যে কোন স্বর্ণ বা রুপার মালিক যদি আপন সম্পদের মালের জাকাত আদায় না করে, তার এ সম্পদকে আল্লাহ জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে কিয়ামতের দিন তা দ্বারা পিঠ, পার্শ্ব এবং কপালে ছ্যাকা দিবেন। আর যখনই তা ঠাণ্ডা হবে সাথে সাথে আগুনে পুণরায় উত্তপ্ত করা হবে। এমন দিনে তাকে শাস্তি দেয়া হবে যে দিনটি হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। আর বান্দার বিচারকার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকবে। অত:পর সে দেখতে পাবে তার গন্তব্য হয় জান্নাতের দিকে নয়তো জাহান্নামের দিকে।’
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
من آتاه الله مالاً فلم يؤد زكاته مثل له يوم القيامة شجاعاً أقرع له زبيبتان يُطوقه يوم القيامة ثم يأخذ بلهزمتيه – يعني شدقيه – يقول أنا مالُك أنا كنزك ” الشجاع : ذكر الحيات، والأقرع : الذي تمعط فروة رأسه لكثرة سُمه
‘আল্লাহ তা‘আলা যাকে সম্পদ দিয়েছেন অথচ সে তার জাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে দুই চোখ বিশিষ্ট বিষাক্ত সাপে পরিণত করা হবে। তারপর সাপটিকে কিয়ামতের সে দিবসে তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপ তার দুই মুখে দংশন করতে করতে বলতে থাকবে, আমি তোমার বিত্ত, আমি তোমার গচ্ছিত সম্পদ।’
সুনানে নাসায়ীতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘যে ব্যক্তি জাকাত আদায় করে না। সে কিয়ামতের দিন একটি অগ্নিখণ্ড নিয়ে আসবে যদ্বারা তার কপালে ও পিঠে দাগ দেয়া হবে।’
বুরাইদা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘যে সম্প্রদায় জাকাত প্রদান করবে না আল্লাহ তাদেরকে দুর্ভিক্ষের মতো বিপদে নিপতিত করবেন।’
জাকাত গরিবের প্রতি কোন করুণা নয় বরং তার হক- যা ধনী ব্যক্তিকে অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ কারণে আবু বকর রা. বলেছেন,
‘যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর যুগে একটি উটের রশিও জাকাত হিসেবে আদায় করত আর এখন তারা যদি জাকাত দিতে অস্বীকার করে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।’ (বুখারি: ১৩১২)
তার এ ভাষণের মর্মার্থই ছিল, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা যাতে কেউ কাউকে তার অধিকার হতে বঞ্চিত করতে না পারে।
জাকাত ফরজ হওয়ার হিকমত
জাকাত ফরজ হওয়ার পেছনে অসংখ্য হিকমত রয়েছে। যেমন- সম্পদ উপার্জনের যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে অনেক তারতম্য রয়েছে। আর এ তারতম্য কমিয়ে ধনী-গরিবের মাঝে ভারসাম্য আনার জন্য মহান আল্লাহ জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ দেখা যায় কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, অর্থ-কড়ি ও ভোগ-বিলাসে মত্ত আছে এবং প্রাচুর্যের চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করছে আর কিছু লোক দারিদ্র সীমার একেবারে নীচে অবস্থান করছে। মানবেতর জীবন যাপন করছে। আল্লাহ এ ব্যবধান দূর করার জন্যই তাদের সম্পত্তিতে জাকাত ফরজ করেছেন। যাতে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমে যায় এবং ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর হয়। অন্যথায় দেশে বা সমাজে হিংসা- বিদ্বেষ, ফিতনা-ফাসাদ ও হত্যা-লুণ্ঠন ছড়িয়ে পড়বে। বিঘিœত হবে সামাজিক শৃংখলা ও স্থিতি ।
এছাড়া জাকাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো, জাকাত মানুষকে কৃপণতা থেকে বিরত রাখে। মানুষকে পরোপকারী, অন্যের ব্যথায় সমব্যথী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হতে সাহায্য করে।
অধিকাংশ দেশেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় জাকাত দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সহায়তা করে দারিদ্র দূর করতে।
জাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুমলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ভাবমর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে এবং আত্মমার্যাদা ও সম্মানবোধ বৃদ্ধি পায়।
জাকাত আদায়ের মাধ্যমে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। তাদের মাঝে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যরে সেতুবন্ধন রচিত হয়। দূর হয় পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ। কারণ গরিবরা যখন ধনীদের সম্পদ দ্বারা উপকৃত হয় এবং তাদের সহানুভূতি লাভ করে, তখন তাদের সহযোগিতা করে এবং তাদের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট হয়।
জাকাত আদায় করলে আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদ এবং ধন-সম্পদের বরকত বাড়িয়ে দেন। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল ইরশাদ করেন- ‘সদকা করার কারণে কখনো সম্পদ কমে না।’ দান-খয়রাত করলে সম্পদের পরিমাণ কমলেও সম্পদের বরকত কমে না। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পদকে তার ভবিষ্যতের জন্য বরকতময় করে দেন এবং তার দান খয়রাতের কারণে তাকে এর চেয়ে উত্তম সম্পত্তি দান করেন।
জাকাত একটি সমাজ বা দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও গতিশীলতাকে স্বাভাবিক রাখার নিশ্চয়তা বিধান করে। জাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থাই বর্তমান অর্থব্যবস্থার সব প্রকার ত্র“টি-বিচ্যুতি ও নানাবিধ সমস্যার যুৎসই সমাধান।
জাকাত মানবাত্মাকে কৃপণতা থেকে মুক্ত করে। জাকাত নামক এ ইবাদতে মালি বা অর্থনৈতিক ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর অনুগ্রহ ও রহমতকে ত্বরান্বিত করে। কুরআনে করিমে ইরশাদ হয়েছে,
 ‏ورحمتي وسعت كل شيء فسأكتبها للذين يتقون ويؤتون الزكاة‏‏ ‏( الأعراف : ১৫৬‏)  
জাকাত আদায় করা আল্লাহর সাহায্য লাভের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
‏ولينصرن الله من ينصره إن الله لقوي عزيز‏, الذين إن مكناهم في الأرض أقاموا الصلاة وآتوا الزكاة‏‏ ‏(‏الحج :‏ ৪০‏‏ – ‏ ৪১‏)
ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এবং দ্বীনি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় জাকাতের কোন বিকল্প নেই।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,
 ‏فإن تابوا وأقاموا الصلاة وآتوا الزكاة فإخوانكم في الدين‏ (‏‏التوبة : ‏ ‏ ১১)
জাকাত আদায় করা মুমিনদের বিশেষ গুণ।
যে ব্যাপারে আল্লাহ প্রশংসা করে বলেন,
‏ ‏والمؤمنون والمؤمنات بعضهم أولياء بعض يأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر ويقيمون الصلاة ويؤتون الزكاة ويطيعون الله ورسوله أولئك سيرحمهم الله إن الله عزيز حكيم‏ ‏ ‏‏(التوبة : ‏ ৭১‏‏)
জাকাত আদায় করা আল্লাহর ঘর আবাদকারীদের বিশেষ গুণ।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআন করিমে তাদের সম্পর্কে বলেন-
 ‏‏إنما يعمر مساجد الله من آمن بالله واليوم الآخر وأقام الصلاة وآتى الزكاة ولم يخش إلا الله (‏التوبة: ‏ ১৮‏)
এবং জাকাত ওই সব লোকের গুণ যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিবাসী হবেন।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করিমে ইরশাদ করেন
‏والذين هم للزكاة فاعلون ‏ (‏المؤمنون: ‏৪‏‏‏)
যাদের ওপর জাকাত ওয়াজিব
যাদের ওপর জাকাত ওয়াজিব তারা তিন প্রকার:
১. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক।
২. যাদের সম্পদের ওপর পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবে ফসলের ক্ষেত্রে এক বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরি নয় বরং ফসলের জাকাতের সম্পর্ক ফসল পাকার সাথে।
৩. ফলের জাকাত ওয়াজিব হয় যখন তা পরিপক্কতা লাভ করে এবং খাওয়ার উপযোগী হয়।
* জাকাত ওই সব লোকের ওপর ওয়াজিব হয় যাদের নিকট সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অথবা তৎসমান অর্থ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক বছর যাবৎ রিজার্ভ বা জমা আছে।
স্বর্ণ রুপার ওপর জাকাত ওয়াজিব হয়
বর্তমান বাজার অনুসারে স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যের ব্যবধান অনেক বেশি। তবে দরিদ্র, অসহায় ও মিসকিনদের সুবিধা বিবেচনায় রুপার মূল্যই জাকাত ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা উচিৎ। তাই বলা যায় সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য (বর্তমান বাজার অনুসারে ১২-১৩ হাজার টাকা) প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যমান থাকার অর্থই হল তার ওপর জাকাত ওয়াজিব। তবে এ অবস্থায় জাকাত ওয়াজিব হওয়ার দু’টি শর্ত আছে- এক. ঋণগ্রস্ত না হতে হবে। দুই. অতিরিক্ত সম্পদের মেয়াদ এক বছর পার হতে হবে।
যেসব সম্পত্তিতে জাকাত ওয়াজিব হয় 
প্রথমত. জমিনে উৎপাদিত ফসল, ফল ও বীজের ওপর জাকাত ওয়াজিব।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآَتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ ﴿১৪১﴾
তোমরা জমিনের ফসল খাও যখন ফসল ফলে, আর ফসল কাটার সময় ফসলের হক্ব আদায় কর। তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আনাম : ১৪১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
‘বৃষ্টির পানি অথবা সমুদ্রের পানি দ্বারা উৎপাদিত ফসলে দশ ভাগের এক ভাগ আর সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত জমিনের ফসলে বিশ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হবে।’ তবে হাদিসের ভাষায় ফসলের পরিমাণ পাঁচ ওছাক হতে হবে।

দ্বিতীয়. গবাদি পশু যেমন- উট, গরু, ছাগল ইত্যাদির ওপর জাকাত ওয়াজিব।
 আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ ﴿৫﴾ وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ ﴿৬﴾
‘এবংগৃহপালিত পশু যা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে রয়েছে শীত বস্ত্রের উপকরণ এবং মানুষের জন্য উপকার।’ (সূরা নাহাল : ৫-৬)
এসব জীব-জন্তুর জাকাত ওয়াজিব হবে যখন মুক্ত বিচরণকারী এবং নিসাব পরিমাণ হয়। এসবের মধ্যে উটের নিসাব হল কমপক্ষে পাঁচটা আর গরু ত্রিশটি এবং ছাগল চল্লিশটি। কিন্তু মুক্ত বিচরণকারী না হলে জাকাত ওয়াজিব হবে না। তবে যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে অবশ্যই জাকাত আদায় করতে হবে।

তৃতীয়. স্বর্ণ, রৌপ্যেও জাকাত ওয়াজিব।
স্বর্ণ ও রৌপ্য যে কোন ধরনের হোক না কেন এর জাকাত ওয়াজিব। তবে স্বর্ণের পরিমাণ কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা এবং রৌপ্যের পরিমাণ সাড়ে বায়ান্ন তোলা হতে হবে।

চতুর্থ. ব্যবসার মালামালের মধ্যে জাকাত ওয়াজিব।
জমি, গবাদি পশু, খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি সবকিছুতেই জাকাত ওয়াজিব যদি ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে। সুতরাং মালিককে বছর শেষে হিসাব করে এসবের জাকাত পরিশোধ করতে হবে।
জাকাতের বিবিধ উপকারিতা
১. দারিদ্র বিমোচন: 
আগেই উল্লেখ করেছি জাকাত দারিদ্র বিমোচনে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। ধনী-গরিবের মধ্যকার বৈষম্য দূর করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর ধনীদের শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধে সহায়তা করে। ‘ধনীরা আরো ধনী আর গরিবরা আরো গরিব’ হওয়ার নীতিহীন সনাতনী ধারা বন্ধ করতে পারে একমাত্র এই জাকাত ব্যবস্থা। ইসলামে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে ব্যবধান মাত্র চল্লিশ ভাগের একভাগ। অর্থাৎ একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির নিকট চল্লিশ লাখ টাকা থাকলে সেক্ষেত্রে অপর জনের নিকট এক লাখ টাকা থাকবে। এভাবে ঠিক মতো জাকাত আদায় করা হলে ক’দিন পরে গরিব বা জাকাত গ্রহণ করার মত লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে না!
২. জাকাতের দ্বারা মানুষের সম্পদ বিশুদ্ধ ও পবিত্র হয়:
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
‘তাদের সম্পদ হতে আপনি জাকাত গ্রহণ করুন, যা তাদের পবিত্র করবে এবং করবে তাদেরকে পরিশুদ্ধ।’
মানুষের সম্পত্তিতে বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা আর মরীচিকার প্রবেশ ঘটে। এসব দূর করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা জাকাতের বিধান প্রবর্তন করেছেন। সেহেতু জাকাত আদায়ের মাধ্যমে মানুষের সম্পত্তি কলুষ ও আবর্জনা মুক্ত এবং পবিত্র হয়।
৩. জাকাত মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করে: 
জাকাত আদায় করার দ্বারা মানুষের ধন-সম্পদ বাড়তে থাকে। বরকতে কানায় কানায় ভরে ওঠে মানুষের সম্পদ।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ ﴿২৭৬﴾
৪- জাকাত মানুষকে কৃপণতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে:
জাকাত আদায়ের মাধ্যমে কৃপণতা দূর হয়। মানুষের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহের উদ্রেক হয়। সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত প্রলম্বিত হয়।
জাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ 
আল্লাহ তা’আলা কুরআন পাকে জাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ উল্লেখ করে দিয়েছেন। কুরআনে জাকাতের অর্থ ব্যয়ের জন্য ৮টি খাত উল্লিখিত হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاِبْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
১। ফকির: ফকির যারা নিজেদের সাধারণ জীবন যাপন করতে পারে না। অনেক দু:খে-কষ্টে কালাতিপাত করে- তাদেরকে জাকাত দেয়া হবে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে,
‘তোমাদের মধ্যে যারা ধনী তাদের থেকে জাকাত নেয়া হবে, আর গরিবের মাঝে বিতরণ করা হবে।’
২। মিসকিন: সহায়-সম্বলহীন হৃতসর্বস্ব ব্যক্তি যার নিকট নগদ অর্থ বলতে কিছুই নেই- এমন লোকদের জাকাত দেয়া হবে।
৩। কর্মকর্তা-কর্মচারী: জাকাতের পয়সা বা সম্পদ উসুল করার কাজে নিয়োজিত কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন ভাতার কাজে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা হবে। চাই এরা ধনী হোক অথবা গরিব। সর্বাবস্থায় এ জাকাতের থেকে তারা তাদের বেতন ভাতা গ্রহণ করতে পারবে।
৪। কৃতদাসকে মুক্তকরার জন্য: কৃতদাস বা কৃতদাসীকে মুক্ত করার জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
৫। মুআল্লাফাতে কুলুব: অমুসলিম বা কাফের সম্প্রদায়ের জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। যাতে তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাদের অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। একমাত্র এ ধরনের কোন উদ্দেশ্য ছাড়া অমুসলিমদের মধ্যে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না।
৬। ঋণগ্রস্ত: ঋণগ্রস্ত কোন ব্যক্তির ওপর তার ঋণের বোঝা কমানো বা ঋণ মুক্ত করার উদ্দেশ্যে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।
৭। ফি সাবিলিল্লাহ খাত: ফি সাবিলিল্লাহ বলতে যারা আল্লাহর পথে বিভিন্নভাবে জিহাদরত তাদের সার্বিক সাহায্যার্থে জাকাতের অর্থ প্রদান করা যাবে।
৮। মুসাফিরদের জন্য: কোন মুসাফির ব্যক্তি পথিমধ্যে অর্থাভাবে বিপদগ্রস্থ বা অসহায় হয়ে পড়েছে। বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছার মত কোন সম্বল তার সঙ্গে নেই। এমতাবস্থায় জাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা বা লোকটির জন্য জাকাতের অর্থ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ বৈধ।
জাকাত আদায় করার দায়িত্ব
জাকাত আদায় করার দায়িত্ব সরকার বা রাষ্ট্রের। কিন্তু সমকালীন দুনিয়ায় ইসলামী অনুশাসন না থাকায় কোথাও জাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি চালু নেই। যার কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বটেই ব্যক্তি পর্যায়েও জাকাত আদায়ের ব্যাপারে উদাসীনতা দেয়া যায়। কিয়ামতের কঠিন বিপদের দিনে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে হলে জাকাত আদায় করতে হবে অবশ্যই। এ ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত আল্লাহ তা‘আলার কাছে গৃহীত হবে না। প্রতাপশালী বিচারকের সামনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই জাকাত আদায় করতে হবে। যেভাবে হোক না কেন জাকাত দিতেই হবে- রাষ্ট্র বা সরকার জাকাত আদায় করতে আসুক বা না আসুক। মসজিদ আছে ইমাম নেই বলে যেমন নামাজ থেকে মাফ পাওয়া যায় না জাকাত উসুলকারী রাষ্ট্র বা লোক নেই বলে জাকাত আদায়ের কঠিন ফরজ থেকেও পলায়নের সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হলেও জাকাত দিতে হবে। অন্যথায় জাকাত অনাদায়ের যে শাস্তি নির্ধারিত আছে তার অবধারিত কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে বুঝবার এবং তদনুযায়ী আমল করবার তাওফিক দান করুন। আমীন।

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button