মুখমন্ডলে আঘাত করা ও দাগ দেওয়া
প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যিনি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।
মূল : মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ । অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الضَّرْبِ فِى الْوَجْهِ وَعَنِ الْوَسْمِ فِى الْوَجْهِ–
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুখমন্ডলে আঘাত করতে এবং মুখমন্ডলে দাগ দিতে নিষেধ করেছেন’।[1]
মুখমন্ডলে আঘাতের বিষয়টি কিছু মাতা-পিতা ও শিক্ষকদের থেকে বেশী প্রত্যক্ষ করা যায়। তারা সন্তানদের বা ছাত্রদের শাসন করার জন্য হাত কিংবা অন্য কিছু দ্বারা মুখমন্ডলে মেরে থাকে। অনেকে বাড়ীর চাকরদের সাথে এরূপ করে থাকে। এতে আল্লাহ তা‘আলা যে চেহারার বদৌলতে মানুষকে সম্মানিত করেছেন তাকে অমর্যাদা করার সাথে সাথে অনেক সময় মুখমন্ডলের কোন একটি ইন্দ্রিয় অকেজো হয়ে পড়তে পারে। ফলে অনুশোচনা ছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে ক্বিছাছ দেওয়া লাগতে পারে।
পশুর মুখমন্ডলে দাগ দেওয়া কাজটি পশু মালিকদের সাথে জড়িত। তারা স্ব স্ব পশু চেনা ও হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়ার জন্য পশুগুলির মুখে দাগ দিয়ে থাকে। এটা হারাম। এতে পশুর চেহারা ক্ষত করা ছাড়াও উহাকে কষ্ট দেওয়া হয়। কেউ যদি দাবী করে যে, এরূপ দাগ দেওয়া তাদের গোত্রের একটি রীতি এবং গোত্রের বিশেষ চিহ্ন, তাহলে এটুকু করার অবকাশ থাকতে পারে যে শরীরের অন্য কোথাও দাগ বা কোন চিহ্ন দিবে; মুখমন্ডলে নয়।
[1]. মুসলিম; মিশকাত হা/৪০৭৭।
শারঈ কারণ ব্যতীত তিন দিনের ঊর্ধ্বে কোন মুসলমানের সাথে সম্পর্কছেদ করা
মুসলমানে মুসলমানে সম্পর্ক বিনষ্ট করা শয়তানের অন্যতম চক্রান্ত। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসারী অনেকেই শারঈ কোন কারণ ছাড়াই মুসলিম ভাইদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। নেহায়েত বস্ত্তগত কারণে কিংবা দুর্বল কোন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ছিন্ন সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে। তারা কেউ একে অপরের সঙ্গে কথা না বলার শপথ করে, তার বাড়ীতে প্রবেশ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। রাস্তায় দেখা হলে পাশ কেটে চলে যায়। মজলিসে হাযির হলে তার আগে-পিছের লোকদের সঙ্গে করমর্দন করে কিন্তু তাকে এড়িয়ে যায়। ইসলামী সমাজে দুর্বলতা অনুপ্রবেশের এটি অন্যতম কারণ। এর শারঈ হুকুম চূড়ান্ত ও পরকালীন শাস্তি কঠোর। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
لاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثٍ فَمَنْ هَجَرَ فَوْقَ ثَلاَثٍ فَمَاتَ دَخَلَ النَّارَ–
‘কোন মুসলমানের জন্য তার ভাইয়ের সাথে তিন দিনের ঊর্ধ্বে সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকা বৈধ নয়। যে মুসলমান তিন দিনের ঊর্ধ্বে সম্পর্ক ছেদ করে থাকে। অতঃপর মারা যায় সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[1]
অন্যত্র তিনি বলেন, مَنْ هَجَرَ أَخَاهُ سَنَةً فَهُوَ كَسَفْكِ دَمِهِ ‘যে ব্যক্তি তার ভাইকে এক বৎসর অবধি পরিত্যাগ করে থাকে সে তার রক্তপাতকারী সমতুল্য’।[2]
মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিণাম এত মারাত্মক যে, উহার ফলে আল্লাহর ক্ষমা হতে বঞ্চিত হতে হয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) এ প্রসঙ্গে নবী করীম (ছাঃ) থেকে নিম্নোক্ত হাদীছ বর্ণনা করেছেন,
تُعْرَضُ أَعْمَالُ النَّاسِ فِى كُلِّ جُمُعَةٍ مَرَّتَيْنِ يَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَيَوْمَ الْخَمِيسِ فَيُغْفَرُ لِكُلِّ عَبْدٍ مُؤْمِنٍ إِلاَّ عَبْدًا بَيْنَهُ وَبَيْنَ أَخِيهِ شَحْنَاءُ فَيُقَالُ اتْرُكُوا أَوِ ارْكُوا هَذَيْنِ حَتَّى يَفِيْئَا–
‘প্রতি সপ্তাহে বান্দার আমল আল্লাহর সমীপে দু’বার করে পেশ করা হয়। সোমবারে একবার ও বৃহস্পতিবারে একবার। তখন সকল বিশ্বাসী বান্দাকেই ক্ষমা করা হয়; কেবল সেই লোককে ক্ষমা করা হয় না, যার সাথে তার ভাইয়ের শত্রুতা আছে। তাদের দু’জন সম্পর্কে বলা হয়, ‘এ দু’জনকে বাদ রাখ কিংবা অবকাশ দাও, যে পর্যন্ত না তারা দু’জন আল্লাহর পথে ফিরে আসে’।[3]
অর্থাৎ শত্রুতা পরিহার না করা পর্যন্ত তাদের ক্ষমা করা নিষিদ্ধ।
বিবাদকারীদ্বয়ের মধ্যে যে তওবা করবে, তাকে তার সঙ্গীর নিকটে গিয়ে সাক্ষাত করা ও সালাম প্রদান করা যরূরী। যদি সে তা করে কিন্তু তার সঙ্গী সাক্ষাত না দেয় কিংবা সালামের জবাব না দেয় তবে সে দোষমুক্ত হয়ে যাবে এবং দন্ড যা কিছু তা অস্বীকারকারীর উপরে পতিত হবে।
আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন,
لاَ يَحِلُّ لِرَجُلٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثِ لَيَالٍ ، يَلْتَقِيَانِ فَيُعْرِضُ هَذَا وَيُعْرِضُ هَذَا وَخَيْرُهُمَا الَّذِى يَبْدَأُ بِالسَّلاَمِ–
‘কোন ব্যক্তির জন্য তার ভাইয়ের সাথে তিন দিনের বেশী সম্পর্ক ছেদ করে থাকা বৈধ নয়। (সম্পর্কছেদের চিহ্ন স্বরূপ) তাদের দু’জনের সাক্ষাত হলে দু’জনই মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাদের দু’জনের মধ্যে সে-ই উত্তম হবে, যে প্রথমে তার সঙ্গীকে সালাম দিবে’।[4]
হাঁ, যদি সম্পর্কছেদ করার শারঈ কোন কারণ পাওয়া যায়। যেমন- সে ছালাত আদায় করে না কিংবা বেপরোয়াভাবে অন্যায়-অশ্লীল কাজ করে চলে তাহলে লক্ষ্য করতে হবে, সম্পর্কচ্ছেদই তার জন্য মঙ্গলজনক না সম্পর্ক রক্ষাই মঙ্গলজনক। যদি সম্পর্ক ছেদে তার মঙ্গল হয় এবং সে সৎপথে ফিরে আসে তাহলে সম্পর্কছেদ করা ফরয হয়ে দাঁড়াবে। আর যদি মঙ্গলজনক না হয়ে বরং আরো বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও পাপ প্রবণতা বেড়ে যায় তাহলে সম্পর্ক ছিন্ন করা ঠিক হবে না। কেননা তাতে সংশোধন না হয়ে বরং বিশৃঙ্খলা আরো বেড়ে যাবে। সুতরাং তার সঙ্গে সংস্রব বজায় রেখে যথাসাধ্য নছীহত করে যেতে হবে।[5]
سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك-
اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب-
[1]. আহমাদ, আবুদাঊদ; মিশকাত হা/৫০৩৫।
[2]. আবুদাঊদ; মিশকাত হা/৫০৩৬; সনদ ছহীহ।
[3]. মুসলিম; মিশকাত হা/৫০৩০।
[4]. বুখারী হা/৬০৭৭।
[5]. যেমন- নবী করীম (ছাঃ) কা‘ব বিন মালিক (রাঃ)-এর সঙ্গে তাবুক যুদ্ধে বিনা কারণে অংশ না নেয়ার জন্য ৫০ দিনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। এই সম্পর্কছেদ তার জন্য মঙ্গলজনক ছিল। কিন্তু মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গীদের সাথে এক দিনের তরেও তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট না করাই তুলনামূলক বেশী মঙ্গল ছিল।
বিলাপ ও মাতম করা
অনেক মহিলা আছে যারা চেঁচিয়ে কাঁদে, মৃতের গুণাবলী উল্লেখ করে মাতম করে, গালে-মুখে থাপ্পড় মারে। এগুলি বড় অন্যায়। অনুরূপভাবে কাপড় ও পকেট ছিঁড়ে, চুল উপড়িয়ে, বেনী বেঁধে বা জড়িয়ে ধরে বিলাপ করাও মহা অন্যায়। এতে আল্লাহর ফায়ছালার প্রতি অসন্তোষ ও বিপদে অধৈর্যের পরিচয় মেলে। যে এমন করবে নবী করীম (ছাঃ) তার প্রতি লা‘নত করেছেন। এ সম্পর্কে আবু উমামা (রাঃ) বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ الْخَامِشَةَ وَجْهَهَا وَالشَّاقَّةَ جَيْبَهَا وَالدَّاعِيَةَ بِالْوَيْلِ وَالثُّبُورِ–
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুখমন্ডল ক্ষত-বিক্ষতকারিণী, পকেট ফাড়নে ওয়ালী এবং দুর্ভোগ ও ধ্বংস প্রার্থনাকারিণীর উপর লা‘নত করেছেন’।[1]
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَطَمَ الْخُدُودَ ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ–
‘যে গালে থাপ্পড় মারে, পকেট ছিঁড়ে ফেলে ও জাহেলিয়াতের রীতি-নীতির প্রতি আহবান জানায় সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[2]
তিনি আরো বলেছেন,
اَلنَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ–
‘মাতমকারিণী মৃত্যুর পূর্বে তওবা না করলে ক্বিয়ামত দিবসে তাকে আলকাতরার পাজামা ও মরিচাযুক্ত বর্ম পরিহিতা অবস্থায় তোলা হবে’।[3]
সুতরাং কারো মৃত্যু বা বিপদে বিলাপ-মাতম ও আহাজারী করা বড়ই অন্যায়।
[1]. ইবনু মাজাহ হা/১৫৮৫ সনদ ছহীহ।
[2]. বুখারী হা/১২৯৪।
[3]. মুসলিম; মিশকাত হা/১৭২৭।
কোন মুসলমানকে অভিশাপ দেওয়া এবং যে অভিশাপ পাওয়ার যোগ্য নয় তাকে অভিশাপ দেওয়া[1]
অনেকেই রাগের সময় জিহবাকে সংযত রাখতে পারে না। ফলে বেদিশা হয়ে লা‘নত করে বসে। তাদের লা‘নতের কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। মানুষ, পশু, জড় পদার্থ, দিন-ক্ষণ এমনকি নিজের সন্তান-সন্ততিদেরও তারা লা‘নত করে বসে। দেখা যায়, স্বামী স্বীয় স্ত্রীকে লা‘নত করে, আবার স্ত্রীও স্বামীকে লা‘নত করে। এটি একটি মারাত্মক অন্যায়। আবু যায়েদ ছাবিত বিন যাহহাক আনছারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ لَعَنَ مُؤْمِنًا فَهُوَ كَقَتْلِهِ ، وَمَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهْوَ كَقَتْلِهِ ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে লা‘নত করল বা কাফের বলে গালি দিল, সে যেন তাকে হত্যা করল’।[2]
মহিলাদেরকে বেশী বেশী লা‘নত করতে দেখা যায়। এজন্যে নবী করীম (ছাঃ) মহিলাদের জাহান্নামী হওয়ার নানা কারণের মধ্যে এটি একটি বলে উল্লেখ করেছেন।[3] এমনিভাবে লা‘নতকারীরা ক্বিয়ামত দিবসে সুফারিশকারীও হতে পারবে না।
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার এই যে, অন্যায়ভাবে লা‘নত করলে তা লা‘নতকারীর উপর বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। তাতে লা‘নতকারী মূলতঃ নিজকেই আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রার্থনাকারী হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং খুব নিরুপায় না হলে ও শারঈ অনুমোদন ক্ষেত্র ব্যতীত লা‘নত করা ঠিক নয়।
[1]. লা‘নত অর্থ রহমত বা দয়া থেকে দূর করে দেওয়া। উহার বাংলা প্রতিশব্দ অভিশাপ। কাউকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করার জন্য বদ দো‘আকে এক কথায় লা‘নত বলে। অহেতুক লা‘নত এজন্যই মারাত্মক অপরাধ ও হারাম।-অনুবাদক
[2]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৩৪১০।
[3]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/১৯।
মন্তব্য করুন