প্রবন্ধ

ক্যানভাস, প্রাচীর গাত্র, কাগজ ইত্যাদিতে প্রাণীর ছবি অঙ্কন করা

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যিনি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

মূল : মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

যে সকল হারামকে মানুষ হালকা মনে করে

আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُونَ ‘নিশ্চয়ই ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহর বিচারে কঠোর শাস্তি প্রাপ্তরা হবে ছবি নির্মাতাগণ’।[1]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ كَخَلْقِى ، فَلْيَخْلُقُوا حَبَّةً ، وَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً

‘যারা আমার সৃষ্টির ন্যায় সৃষ্টি করতে তৎপর হয় তাদের থেকে বড় যালেম আর কে আছে? এতই যদি পারে তো তারা একটা শস্য দানা সৃষ্টি করুক কিংবা অণু সৃষ্টি করুক’।[2]

ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

كُلُّ مُصَوِّرٍ فِى النَّارِ يَجْعَلُ لَهُ بِكُلِّ صُورَةٍ صَوَّرَهَا نَفْسًا فَتُعَذِّبُهُ فِى جَهَنَّمَ

‘প্রত্যেক ছবি নির্মাতা জাহান্নামে যাবে। সে যত ছবি অঙ্কন করেছে তার প্রত্যেকটির বিনিময়ে তার জন্য একটি করে প্রাণী তৈরী করা হবে। সে জাহান্নামে (তাকে) শাস্তি দেবে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘তোমাদেরকে যদি ছবি অাঁকতেই হয় তাহলে বৃক্ষ ও যার ‘রূহ’ নেই তার ছবি অাঁক’।[3]

এ সকল হাদীছ হতে প্রমাণ মেলে যে, মানুষ, পশু ইত্যাকার যে কোন প্রাণীর ছবি অাঁকা হারাম। চাই তার ছায়া থাকুক বা না থাকুক, তা ছাপা হৌক, কিংবা খোদাইকৃত হৌক, কিংবা অঙ্কিত হৌক বা ভাষ্কর্য হৌক কিংবা ছাঁচে ঢালাই করা হৌক। কেননা ছবি হারাম সংক্রান্ত হাদীছের আওতায় এ সবই পড়ে। আর যে ব্যক্তি মুসলমান সে তো শরী‘আতের কথা অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নিবে। সে এ বিতর্ক করতে যাবে না যে, আমি তো উহার পূজা করি না বা উহাকে সিজদা করি না। একজন জ্ঞানী লোক যদি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমাদের যুগে ব্যাপক বিস্তার লাভকারী ছবির মধ্যে নিহিত একটি ক্ষতির কথাও চিন্তা করেন তাহলে শরী‘আতে ছবি হারামের তাৎপর্য তিনি অনুধাবন করতে পারবেন। বর্তমানে এমন অনেক ছবি আছে যার কারণে কুপ্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, কামনার জোয়ার সৃষ্টি হয়। এমনকি ছবির জন্য যিনায় লিপ্ত হওয়াও বিচিত্র নয়।

এছাড়া মুসলমানরা নিজেদের ঘরে প্রাণীর ছবি রাখবে না। কেননা প্রাণীর ছবি থাকলে গৃহে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تَدْخُلُ الْمَلاَئِكَةُ بَيْتًا فِيْهِ كَلْبٌ وَلاَ تَصَاوِيرُ ‘যে বাড়ীতে কুকুর ও ছবি থাকে সেই বাড়ীতে ফেরেশতা প্রবেশ করে না’।[4]

কোন কোন বাড়ীতে কাফিরদের দেব-দেবীর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। বলা হয় যে, এগুলি আমরা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য রেখেছি। অন্যান্য ছবির তুলনায় এগুলি আরও কঠোর হারাম। অনুরূপভাবে প্রাচীর গাত্রে টাঙানো ছবিও বেশী ক্ষতিকারক। এসব ছবি কত যে সম্মান পায়, কত যে দুঃখ জাগরুক করে, কত যে গর্ব বয়ে আনে তার কোন ইয়ত্তা নেই।

ছবিকে কখনো স্মৃতি বলা যায় না। কেননা, মুসলিম আত্মীয় ও প্রিয়জনের স্মৃতি তো অন্তরে বিরাজ করে। একজন মুসলমান তাদের জন্য রাববুল আলামীনের নিকটে রহমত ও মাগফেরাত কামনা করবে। তাতেই তাদের স্মৃতি জাগরুক থাকবে।

সুতরাং সর্বপ্রকার প্রাণীর ছবি বাড়ী থেকে সরিয়ে দেওয়া ও নিশ্চিহ্ন করে ফেলা আবশ্যক। হ্যাঁ, যেগুলি নিশ্চিহ্ন করা দুষ্কর ও আয়াসসাধ্য সেগুলি ব্যতিক্রম বলে গণ্য হবে। যেমন সাধারণ্যে প্রচলিত কৌটাবদ্ধ খাদ্যদ্রব্য বা টিনজাত খাদ্য সমগ্রী ও অন্যান্য নানা ধরনের বস্ত্ততে অঙ্কিত ছবি, অভিধান, রেফারেন্স বুক ও অন্যান্য পাঠ্য বইয়ের ছবি ইত্যাদি। তবে যথাসম্ভব সেগুলি অপসারিত করা গেলে করবে। বিশেষ করে মন্দ ছবি রাখবে না।

পরিচয়পত্রে ব্যবহৃত ছবি হারামের আওতাভুক্ত হবে না। কেননা সফরে উহার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এছাড়া কোন কোন বিদ্বানের মতে, যে সব ছবির ক্বদর নেই; বরং তা পদদলিত করার ন্যায় গণ্য, সে সব ছবি প্রয়োজনে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘তোমরা সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর’ (তাগাবুন ১৬)


[1]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৪৪২৯।

[2]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৪৪৯৬।

[3]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৪৪৯৮।

[4]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৪৪৮৯।

সাদা চুলে কালো খেযাব ব্যবহার করা

সাদা চুলকে কালো রঙে রঞ্জিত করা হারাম। হাদীছে কালো খেযাব সম্পর্কে যে হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে তাতে একথাই প্রমাণিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

يَكُونُ قَوْمٌ يَخْضِبُونَ فِى آخِرِ الزَّمَانِ بِالسَّوَادِ كَحَوَاصِلِ الْحَمَامِ لاَ يَرِيحُونَ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ

‘শেষ যামানায় একদল লোক কবুতরের বুকের ন্যায় কাল খেযাব ব্যবহার করবে। তারা জান্নাতের কোন সুগন্ধি পাবে না’।[1]

অনেক চুলপাকা ব্যক্তিকে এ কাজ করতে দেখা যায়। তারা কাল রং দ্বারা সাদা চুল রাঙিয়ে নিজেদেরকে যুবক কিংবা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী বলে যাহির করে। এতে প্রতারণা, আল্লাহর সৃষ্টিকে গোপন করা ও মিথ্যা আত্মতৃপ্তি ব্যতীত আর কিছু হয় না। এর ফলে ব্যক্তিগত চালচলনের উপর নিঃসন্দেহে এক প্রকার কুপ্রভাব পড়ে। অন্য মানুষ তাতে প্রতারিত হয়।

নবী করীম (ছাঃ) পাকা চুল খেযাব করেছেন মেহেদি বা অনুরূপ কোন জিনিস দ্বারা। যাতে হলুদ, লাল ইত্যাদি মৌলিক রং ফুটে ওঠে। তবে কাল রং দিয়ে কখনোই নয়।

আবুবকর (রাঃ)-এর পিতা আবু কুহাফা (রাঃ)-কে মক্কা বিজয়ের দিন যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সামনে হাযির করা হয় তখন তার চুল-দাড়ি এত সাদা হয়ে গিয়েছিল যে, তা ‘ছাগামা’ (কাশ) ফুলের ন্যায় ধবধবে দেখাচ্ছিল। তিনি তাকে দেখে বললেন, غَيِّرُوا هَذَا بِشَىْءٍ وَاجْتَنِبُوا السَّوَادَ ‘তোমরা কোন কিছু দ্বারা এটা পরিবর্তন করে দাও। তবে কাল রং থেকে বিরত থাকো’।[2] নারীদের বিধান পুরুষদের অনুরূপ। তারাও পাকা চুল কালো রঙে রাঙাতে পারবে না।


[1]. আবুদাঊদ হা/৪২১২; ছহীহুল জামে‘ হা/৮১৫৩।

[2]. মুসলিম; মিশকাত হা/৪৪২৪

মিথ্যা স্বপ্ন বলা

মানুষের মাঝে মর্যাদার আসন লাভ, আলোচনার পাত্র হওয়া, আর্থিক সুবিধা লাভ কিংবা শত্রুকে ভীতচকিত করার মানসে মিথ্যা স্বপ্ন বলার অভ্যাস কিছু মানুষের আছে। জনসাধারণের অনেকেই স্বপ্নে বিশ্বাসী। স্বপ্নের সাথে তাদের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। তারা একে বাস্তব মনে করে ও এ মিথ্যা স্বপ্ন দ্বারা প্রতারিত হয়। ফলে এসব মিথ্যা স্বপ্ন যে বলে বেড়ায় তার জন্য কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِنَّ مِنْ أَعْظَمِ الْفِرَى أَنْ يَدَّعِىَ الرَّجُلُ إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ، أَوْ يُرِىَ عَيْنَهُ مَا لَمْ تَرَ، أَوْ يَقُولُ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا لَمْ يَقُلْ

‘সবচেয়ে বড় মনগড়া বা মিথ্যার মধ্যে রয়েছে ঐ ব্যক্তি, যে নিজেকে স্বীয় পিতা ব্যতীত অন্যের সন্তান হিসাবে আখ্যায়িত করে, যে স্বপ্ন সে দেখেনি তা দেখার দাবী করে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা বলেননি তাঁর নামে তা বলা’।[1]

তিনি আরও বলেছেন,

مَنْ تَحَلَّمَ بِحُلُمٍ لَمْ يَرَهُ، كُلِّفَ أَنْ يَعْقِدَ بَيْنَ شَعِيرَتَيْنِ، وَلَنْ يَفْعَلَ

‘যে ব্যক্তি স্বপ্নে যা দেখেনি তা দেখার ভান বা দাবী করে তাকে দু’টি চুলে গিরা দিতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু সে তা কখনই করতে পারবে না’।[2]

দু’টি চুলে গিরা দেওয়া একটি অসাধ্য কাজ। সুতরাং কাজ যেমন হবে তার ফলও তেমন হবে।


[1]. বুখারী হা/৩৫০৯।

[2]. বুখারী; মিশকাত হা/৪৪৯৯।

পেশাবের পর পবিত্র না হওয়া

মানব প্রকৃতিকে দুরস্ত করার যত উপায়-উপকরণ আছে ইসলাম তার সবই উপস্থাপন করেছে। এটি ইসলামের একটি বড় সৌন্দর্য। নাপাকী দূর করা এসব উপায়ের একটি। এ কারণেই ‘ইসতিনজা’ বা শৌচকার্য বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং কিভাবে পাক-পবিত্রতা অর্জিত হবে তার নিয়ম বাতলে দেওয়া হয়েছে।

অনেকে নাপাকী দূরীকরণে অলসতা করে থাকে। যার ফলে তাদের কাপড় ও দেহ অপবিত্র হয়ে যায় এবং ফলশ্রুতিতে তাদের ছালাত হয় না। নবী করীম (ছাঃ) উহাকে কবর আযাবের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) মদীনার একটি খেজুর বাগানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি দু’জন (মৃত) ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শুনতে পান। কবরে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। তা শুনে তিনি বললেন, এই দু’টো লোককে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বড় কোন কারণে নয়। অবশ্য গুনাহ হিসাবে এগুলি কবীরা। তাদের একজন পেশাব শেষে পবিত্র হত না আর অন্যজন চোগলখুরী করে বেড়াত’।[1] নবী করীম (ছাঃ) বরং এতদূর বলেছেন যে, أَكْثَرُ عَذَابِ الْقَبْرِ فِى الْبَوْلِ ‘বেশীরভাগ কবর আযাব পেশাবের কারণে হয়’।[2]

পেশাবের ফোঁটা বন্ধ না হতেই যে দ্রুত পেশাব হতে উঠে পড়ে কিংবা এমন কায়দায় বা স্থানে পেশাব করে যেখান থেকে পেশাবের ছিঁটা এসে গায়ে বা কাপড়ে লাগে সেও এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে।

কাফেরদের দেখাদেখি আমাদের মধ্যে অনেকস্থানেই দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে টয়লেট তৈরী করা হয়। এগুলি খোলামেলাও হয়। মানুষ কোন লজ্জা-শরম না করেই চলাচলকারী মানুষের সামনে সেখানে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে শুরু করে। তারপর পেশাবের নাপাকী সমেতই কাপড় পরে নেয়। এতে দু’টি বিশ্রী হারাম একত্রিত হয়। এক- সে তার লজ্জাস্থানকে মানুষের দৃষ্টি থেকে হেফাযত করে না। দুই- সে পেশাব হতে পবিত্রতা অর্জন করে না।


[1]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৬০৭৫।

[2]. আহমাদ হা/৮৩১৩, ছহীহ তারগীব হা/১৫৮।

 [box type=”info” align=”” class=”” width=”600″]আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক! মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের শ্বাশত বাণী ছড়িয়ে দিন। আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ ইত্যাদি ওয়েবসাইটে শেয়ার করুন এবং সকলকে জানার সুযোগ করে দিন। নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে -এ লাইক করুন[/box]

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button