প্রবন্ধ

ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায়

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যানি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

মূল : মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ | অনুবাদক : আব্দুল হাকীম বিন আব্দুল হাফীজ

ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায়
ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। যিনি তাঁর সুস্পষ্ট গ্রন্থ পবিত্র কুরআনে বলেন, وَ قُوۡمُوۡا لِلّٰہِ قٰنِتِیۡنَ ‘তোমরা বিনীতভাবে আল্লাহর জন্য দণ্ডায়মান হও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩৮)। আল্লাহ তা‘আলা ছালাত সম্পর্কে বলেন, لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ وَ اِنَّہَا ‘নিশ্চয় বিনয়ীগণ ছাড়া ছালাত অন্যদের উপর কঠিন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৪৫)। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুত্তাক্বীদের ইমাম ও বিনয়ীদের সরদার মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল ছাহাবীর উপর।
অতঃপর নিশ্চয় ছালাত দ্বীন-ইসলামের কার্যগত রুকনসমূহের মাঝে সবচেয়ে বড় রুকন। ছালাতে একাগ্রতা ও বিনয়াবনত অর্জন করা মুখ্য উদ্দেশ্য এবং ইসলামী শরী‘আতের প্রকৃত চাহিদা। পক্ষান্তরে আল্লাহর শত্রু ইবলীস বানী আদমকে পথভ্রষ্ট ও বিপদগ্রস্ত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে অঙ্গীকার করেছে যে,
ثُمَّ لَاٰتِیَنَّہُمۡ مِّنۡۢ بَیۡنِ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مِنۡ خَلۡفِہِمۡ وَ عَنۡ اَیۡمَانِہِمۡ وَ عَنۡ شَمَآئِلِہِمۡ
‘অতঃপর আমি পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাদের সম্মুখ দিয়ে, পেছন দিয়ে, ডান দিক দিয়ে এবং বাম দিক দিয়ে আসব’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ১৭)।
শয়তানের মূল চক্রান্ত ও উদ্দেশ্য হল মানুষকে যেকোন উপায়ে অন্য মনষ্ক করে ছালাত থেকে দূরে রাখা এবং মুছল্লির মাঝে বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করে ছালাতের মত মহান ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ ও বিশাল ছওয়াব থেকে বঞ্চিত রাখা। যাতে করে ছালাত আদায়ের ছওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। ছালাতে একাগ্রতা-বিনয়াবনত এমন একটি বিষয়, যা পৃথিবী থেকে সর্বপ্রথম উঠিয়ে নেয়া হবে। সেখানে তো আমরা শেষ যামানার মানুষ। এ ক্ষেত্রে হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কথা আমাদের উপর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন,
أَوَّلُ مَا تَفْقِدُوْنَ مِنْ دِيْنِكُمْ الْخُشُوْعُ وَآخِرُ مَا تَفْقِدُوْنَ مِنْ دِيْنِكُم الصَّلَاةُ ورُبَّ مُصَلٍّ لَا خَيْرَ فِيْهِ وَيُوْشِكُ أَنْ تَدْخُلَ الْمَسْجِدَ فَلَا تَرَى فِيْهِمْ خَاشِعًا
‘তোমরা তোমাদের দ্বীনের বিষয়াবলী থেকে সর্বপ্রথম খুশূ‘-একাগ্রতাকে হারিয়ে ফেলবে। আর সবশেষে হারিয়ে ফেলবে ছালাতকে। অনেক মুছল্লী আছে, যাদের ছালাত আদায়ের মাঝে কোন কল্যাণ নেই। অচিরেই এমন একটি সময় আসবে, যখন তুমি মসজিদে প্রবেশ করবে, কিন্তু কোন একাগ্রতার সাথে ছালাত আদায়কারী মুছল্লীকে পাবে না’।[১]
ছালাতে কুমন্ত্রণা সৃষ্টি হওয়ার ফলে একাগ্রতা না থাকার বিষয়টি একজন মুছল্লী নিজে নিজেই অনুভব করে এবং অনেক অভিযোগকারীর নিকট থেকে উত্থাপিত হয়। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। তাই আলোচনাটি আমার নিজের জন্য এবং আমার মুসলিম ভাইদের জন্য উপদেশ স্বরূপ। আল্লাহ তা‘আলার কাছে এই প্রার্থনা করছি যে, তিনি যেন এ আলোচনাটি দ্বারা আমাদের সকলের উপকার সাধন করেন-আমীন!!
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের ৩৩ উপায়
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ – الَّذِیۡنَ ہُمۡ فِیۡ صَلَاتِہِمۡ خٰشِعُوۡنَ
‘অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। যারা নিজেদের ছালাতে একনিষ্ট’ (সূরা আল-মুমিনূন : ১-২)। অর্থাৎ যারা ভীত-সন্ত্রস্ত এবং প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে ছালাতে স্থির থাকে। আর ছালাতে খুশূ‘ বা একাগ্রতার অর্থ হল- প্রশান্ত থাকা, নিশ্চিন্ত থাকা, ধীরস্থিরতা অবলম্বন করা, সুস্থির থাকা, বিনয়ী থাকা এবং গাম্ভীর্যতা অবলম্বন করা। মূলত আল্লাহর ভয় ও তাঁর সম্পর্কে যথাযথ সচেতনতা বান্দাকে ছালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করতে উৎসাহ যোগায় এবং খুশূ‘-একাগ্রতা অর্জনে সহযোগিতা করে।[২] আর খুশূ‘ বা একাগ্রতার প্রকৃত রূপ হল- মহান আল্লাহর সামনে বান্দার অন্তরকে বিনম্র, হীন ও অপমানিত অবস্থায় দাঁড় করানো।[৩]
মুজাহিদ (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহান আল্লাহর বাণী: وَ قُوۡمُوۡا لِلّٰہِ قٰنِتِیۡنَ ‘তোমরা বিনীতভাবে আল্লাহর জন্য দণ্ডায়মান হও’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩৮)। এখানে ‘কুনূত’ অর্থ হল- মহান আল্লাহর ভয়ে রুকূ‘ করা, ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া, বিনম্র হওয়া, দৃষ্টিকে অবনমিত করা এবং সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিনয়ী রূপে প্রকাশ করা।[৪] মূলত একাগ্রতা অর্জনের স্থান হল অন্তর এবং তার ফলাফল প্রকাশের স্থান হল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ অন্তরের আনুগত্য ও অনুসরণ করে থাকে। সুতরাং অলসতা কিংবা ওয়াসওয়াসার কারণে যখন অন্তরের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে ইবাদত বন্দেগী করার মনোভাব নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের অন্তর হল রাজা-বাদশাহর ন্যায় আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ হল তার জন্য নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ন্যায়। তাই তারা রাজা তথা অন্তরের আদেশ পালন করে এবং তার নির্দেশনাবলী বাস্তবায়ন করে। সুতরাং যখন অন্তর তার প্রতিপালকের ইবাদত থেকে পৃথক হওয়ার মাধ্যমে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন সে বেকার হয়ে যায় এবং তার জনসাধারণও ধ্বংস হয়ে যায়। আর জনসাধারণ হল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ। উল্লেখ্য যে, খুশূ‘-একাগ্রতার বিষয়টি প্রকাশ করার নয়, বরং তা গোপন রাখার বিষয়। আর এটাই ইখলাছের প্রকৃত দাবী।
খুশূ‘ বা একাগ্রতার রহস্য ও তাৎপর্য
হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন,
إيَّاكُمْ وَخُشُوْعَ النِّفَاقِ فَقِيْلَ لَهُ وَمَا خُشُوْعُ النِّفَاقِ قَالَ أَنْ تَرَى الْجَسَدُ خَاشِعًا وَالْقَلْبُ لَيْسَ بِخَاشِعٍ
‘তোমরা মুনাফেক্বী একাগ্রতা হতে বেঁচে থাক। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল- মুনাফেক্বী একাগ্রতা কী? তিনি বললেন, তুমি তোমার দেহকে ভীত-সন্ত্রস্ত রূপে প্রকাশ করবে, অথচ তোমার অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত নয়’। ফুযাইল ইবনু ‘ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
كَانَ يُكْرَهُ أَنْ يَّرَي الرَّجُلُ مِنَ الْخُشُوْعِ أَكْثَرَ مِمَّا فِيْ قَلْبِهِ
‘কোন মানুষের অন্তরে যে পরিমাণ একাগ্রতা আছে বাহ্যিকভাবে তার চেয়ে অধিক পরিমাণে একাগ্রতা প্রকাশ করাকে অপসন্দনীয় মনে করা হত’।
পূর্ববর্তীদের কোন একজন ব্যক্তি অপর একজন ব্যক্তিকে দু’কাঁধ ও শরীরকে ঝুঁকানো অবস্থায় দেখে বললেন, হে অমুক! একাগ্রতা এখানে, একথা বলে তিনি তার বুকের দিকে ইশারা করলেন। ওখানে নয়, একথা বলে তিনি দু’কাঁধের দিকে ইশারা করলেন।[৫]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) ঈমানী খুশূ‘ এবং মুনাফেক্বী খুশূ‘ এ দু’টির মাঝে পার্থক্যের বর্ণনায় বলেন, ঈমানী একাগ্রতা হল- আল্লাহ তা‘আলার জন্য বড়ত্ব, মহত্ত্ব, মহিমা, সম্মান, ভয় ও লজ্জা করার মাধ্যমে অন্তর বিনয়ী হওয়া। ফলে ভয়, অপমানবোধ, ভালবাসা, লজ্জা এবং মহান আল্লাহ্র নে‘মতরাজি প্রত্যক্ষ এবং তার পক্ষ হতে অপরাধ ও অন্যায়ের অনুভূতিতে বান্দার অন্তর মহান আল্লাহ্র জন্য পরিপূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়বে। আর যখন বান্দার মাঝে এরূপ অবস্থার আগমন ঘটে, তখন বান্দার অন্তর আল্লাহ্র ভয়ে বিনয়ী হয় এবং সাথে সাথে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোও বিনয়ীভাব প্রকাশ করে। পক্ষান্তরে মুনাফেক্বী একাগ্রতা হল- কৃত্রিমতা ও লৌকিকতাযুক্ত একাগ্রতা ও ভয়-ভীতি, যা শুধু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমেই প্রকাশ হয়, অথচ বান্দার অন্তর তা হতে সম্পূর্ণরূপে খালি। কতক ছাহাবী তাঁদের দু‘আয় বলতেন যে,
أَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ خُشُوْعِ النِّفَاقِ قِيْلَ لَهُ وَمَا خُشُوْعُ النِّفَاقِ قَالَ أَنْ يُّرَى الْجَسَدُ خَاشِعًا وَالْقَلْبُ غَيْرُ بِخَاشِعٍ
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট মুনাফেক্বী একাগ্রতা হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল- মুনাফেক্বী একাগ্রতা কী? তিনি বললেন, দেহকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাবে অথচ প্রকৃতপক্ষে অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত নয়’।
সুতরাং আল্লাহর জন্য ভীতি অবলম্বনকারী ঐ বান্দাকেই বলা যাবে, যার কুপ্রবৃত্তির অগ্নি নিভে প্রশমিত হয়ে গেছে এবং তার বুক থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হওয়াও থেমে গেছে। ফলতঃ তার অন্তর আলোকিত হয়েছে এবং সেখানে আল্লাহর বড়ত্বের প্রদীপ উদিত হয়েছে। তার অন্তর থেকে আল্লাহর ভয় ও মহত্ত্বের প্রভাবে কুপ্রবৃত্তি নিঃশেষ হয়েছে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের তেজ-শক্তি হ্রাস পেয়েছে। তার অন্তর মহান প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত প্রশান্তি এবং আল্লাহকে স্মরণ করার দ্বারা সম্মানিত হয়েছে ও সন্তুষ্টি লাভ করেছে। ফলে সে এভাবেই নিজেকে আল্লাহর জন্য ‘মুখবিত’ তথা বিনয়ী ও প্রশান্তচিত্ত করে নিয়েছে। আর যমীনে তাকেই ‘মুখবিত’ বলা হয়, যা স্থির, সমান ও প্রশান্ত থাকে, যাতে পানি জমা হতে পারে।
অন্তর বিনয়ী ও প্রশান্ত হওয়ার আলামত হচ্ছে, আল্লাহ্র বড়ত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ করে নিজেকে অপমানিত, অপদস্থ ও হীন মনে করে আল্লাহর সামনে এমনভাবে সিজদা করা, যেন সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ না করে মাথা সিজদা থেকে উঠাবে না। সুতরাং এটাই ঈমানের একাগ্রতা। পক্ষান্তরে অহংকারী অন্তর; সে তার অহংকারের কারণে লাফালাফি এবং বাড়াবাড়ি করতে থাকে। তাই সে যমীনের উঁচু স্থানের ন্যায় হয়, যাতে পানি স্থির হয়ে জমা হতে পারে না।
আর মৃত্যুর ভান করা এবং মুনাফেক্বী খুশূ‘ বা একাগ্রতা হচ্ছে এমন অবস্থা, যা কৃত্রিমতা অবলম্বনের মাধ্যমে মানুষকে দেখানোর উদ্দশ্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিজের আয়ত্বে আনার দ্বারা সৃষ্টি হয়। মূলত তার অন্তর নানা রকম কু-প্রবৃত্তি ও চাহিদা দ্বারা একজন যুবকের ন্যায় তরতাজা হয়ে আছে। বাহ্যিক দিক দিয়ে সে একাগ্রতা অবলম্বনকারী হলেও বস্তুত তার শরীরে এমন সব নদ-নদীর সাপ এবং বনের হিংস্র জন্তু বাসা বাঁধে, যেগুলো সব সময় শিকারের অপেক্ষায় থাকে।[৬]
ছালাতে খুশূ‘ বা একাগ্রতা তখনই অর্জিত হয়, যখন অন্তর ছালাতের জন্য পুরোপুরিভাবে নিয়োজিত হয়। সে তার সমস্ত কাজকে বাদ দিয়ে কেবল ছালাত নিয়েই ব্যস্ত হয় এবং অন্য সকল কিছুর উপর ছালাতকেই প্রাধান্য দেয়। তখন ছালাত তার জন্য প্রশান্তিময় হয় এবং তার চক্ষু শীতলকারী হয়। যেমন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, جُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِيْ فِي الصَّلَاةِ ‘ছালাতে আমার চোখের প্রশান্তি দেয়া হয়েছে’।[৭]
আল্লাহ তা‘আলা তার উত্তম বান্দাদের গুণাগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে ছালাতে খুশূ‘ বা একাগ্রতা অবলম্বনকারী নর-নারীর কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন যে, নিশ্চয় তিনি তাদের জন্য ক্ষমা ও বিশাল প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন (সূরা আল-আহযাব : ৩৫)।
ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের উপকারিতা হল- নিশ্চয় তা ছালাতকে বান্দার জন্য সহজ ও হালকা করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ وَ اِنَّہَا لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ
‘তোমরা ধৈর্য এবং ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহ্র নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় ছালাত বিনয়ী ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৪৫)। অর্থাৎ বিনয় অবলম্বনকারী ব্যতীত অন্যদের উপর ছালাতের কষ্টটা খুবই কঠিন।[৮]
ছালাতে একাগ্রতা অবলম্বনের বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইহার মর্যাদা ও প্রভাব খুব দ্রুত হারিয়ে যায় এবং এর অস্তিত্ব খুবই দুর্লভ। বিশেষ করে আমাদের বর্তমান যুগে এসে। কেননা আমাদের যুগটাই হল শেষ যুগ। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
أَوَّلُ شَيْءٍ يُرْفَعُ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ الْخُشُوْعُ حَتَّى لَا تَرَى فِيْهَا خَاشِعًا
‘এই উম্মতের নিকট থেকে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি উঠিয়ে নেয়া হবে তাহল একাগ্রতা। তাই তুমি কাউকে ছালাতে খুশূ‘ বা একাগ্রতা অবলম্বন করতে দেখবে না’।[৯]
কতিপয় সালাফ বলেন, ছালাত হল ঐ দাসীর ন্যায়, যা কোন রাজাকে উপঢৌকন স্বরূপ দেয়া হয়েছে। সুতরাং ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার ধারণা কেমন হতে পারে, যে রাজাকে এমন একটি দাসী উপঢৌকন দিল যা অন্ধ, বধির, প্রতিবন্ধি, হাত-পা বিচ্ছিন্ন, রোগাটে, কুৎসিত ও দুর্গন্ধময় কিংবা এমন একটি দাসী উপঢৌকন দিল, যা মৃত, যার কোন প্রাণ নেই। সুতরাং তোমার ছালাতের সে বিষয়টি কেমন হবে, যা কোন বান্দা উপঢৌকন দিল আর সে তা দ্বারা তার প্রতিপালকের নৈকট্য লাভ করতে চাইল?
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ উত্তম ও পবিত্র। তিনি উত্তম ও পবিত্র ব্যতীত কোন কিছুই কবুল করেন না। আর যে ছালাতের প্রাণ থাকে না, তা কখনও উত্তম ও পবিত্র হতে পারে না। যেমনিভাবে কোন মৃতদাস স্বাধীন করাকে উত্তম ও পবিত্র বস্তু স্বাধীন করার উপর প্রমাণ বহন করে না।[১০]
খুশূ‘ বা একাগ্রতার হুকুম
সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হল- ছালাতে একাগ্রতা আনয়ন করা ওয়াজিব। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
وَ اسۡتَعِیۡنُوۡا بِالصَّبۡرِ وَ الصَّلٰوۃِ وَ اِنَّہَا لَکَبِیۡرَۃٌ اِلَّا عَلَی الۡخٰشِعِیۡنَ
‘তোমরা ধৈর্য এবং ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় ছালাত বিনয়ী ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের উপর কঠিন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ৪৫)। উক্ত আয়াত প্রমাণ বহন করে যে, যারা ছালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করে না তারা আল্লাহ কর্তৃক নিন্দিত। মূলত কোন ওয়াজিব পরিত্যাগ করা কিংবা হারাম কাজে জড়িয়ে পড়ার কারণেই নিন্দা করা হয়ে থাকে। তাই যারা ছালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করে না তাদের নিন্দিত হওয়ার দ্বারা ছালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করা ওয়াজিব হওয়ার প্রতি প্রমাণ বহন করে। ছালাতে একাগ্রতার বিষয়টি অপর আরেকটি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ- الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ-وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ- إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ- فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعَادُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ- وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ- أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ- الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
‘অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। যারা নিজেদের ছালাতে একনিষ্ঠ। যারা অসার কার্যকলাপ হতে বিরত থাকে। যারা যাকাত প্রদানে সক্রিয়। যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে তবে নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ব্যতীত, কেননা এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। সুতরাং কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী। যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। আর যারা নিজেদের ছালাতে যত্নবান থাকে। তারাই হবে উত্তরাধিকারী। যারা ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে’ (সূরা আল-মুমিনূন : ১-১১)।
আল্লাহ তা‘আলা উক্ত আয়াতে সংবাদ দিচ্ছেন যে, কেবল তারাই জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে, যারা তাদের ছালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করবে। তারা ব্যতীত অন্য কেউ জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী হতে পারবে না।
যেহেতু ছালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করা ওয়াজিব এবং তার সাথে সুস্থিরতা এবং বিনয়াবনতা থাকে, সেহেতু যে ব্যক্তি কাকের ঠোকরের ন্যায় ছালাত আদায় করে, তার সিজদায় একাগ্রতা থাকে না। অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তি রুকূ‘ হতে মাথা ঠিকমত উঠায় না এবং মাথা ঝুঁকানোর (সিজদায় যাওয়ার) পূর্বে সুস্থির হয়ে দাঁড়ায় না, সে তার ছালাতে প্রশান্ত ভাব আনতে পারল না। কেননা সুস্থির থাকাই হল প্রশান্ত ভাব। আর যে ব্যক্তি ছালাতে সুস্থির হতে পারল না সে প্রশান্তি অবলম্বন করল না এবং সে তার রুকূ‘ ও সিজদায় একাগ্রতা আনতে পারল না। সুতরাং যে একাগ্রতা অবলম্বন করতে পারল না, সে অপরাধী ও পাপী হিসাবে গণ্য হল।
ছালাতে একাগ্রতার বিষয়টি ওয়াজিব হওয়া মর্মে আরেকটি দলীল হল- যারা ছালাতে একাগ্রতা অবলম্বন করে না নবী করীম ফ তাদেরকে ধমক দিয়েছেন। যেমন তিনি ছালাতে আকাশের দিকে তাকানো ব্যক্তিকে ধমক দিয়েছেন। কেননা নড়াচড়া করা, উপরের দিকে তাকানো এগুলো সবই ছালাতে একাগ্রতা অর্জনের পরিপন্থী।[১১]
[ইনশাআল্লাহ চলবে]
তথ্যসূত্র
[১] মুহাম্মাদ ইবনু আবু বকর ইবনু ক্বাইয়িম আয-জাওযিয়্যাহ, মাদারিজুস সালিকীন বাইনা মানাযিলি ইয়্যাকা না‘বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসাতা‘ঈন, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ হামিদ আল-ফিক্বহী (বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৩ হি./১৯৭৩ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ৫২১।
[২] তাফসীর ইবনু কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪১৪, ছাপা : দারুশ শু‘আব।
[৩] ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫২০।
[৪] তা‘যীমু ক্বাদরিছ ছালাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৮।
[৫] মাদারিজুস সালিকীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫২১।
[৬] ইবনুল ক্বাইয়িম, কিাতবুর রূহ, পৃ. ৩১৪, ছাপা : দারুল ফিক্র, উরদুন।
[৭] তাফসীর ইবনু কাছীর, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৫৬; মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৮, হা/১২৩১৬; ছহীহুল জামে‘, হা/৩১২৪, সনদ ছহীহ।
[৮] তাফসীর ইবনু কাছীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৫।
[৯] হায়ছামী, মাজমাঊয যাওয়ায়েদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৬-এ বলেন, ইমাম ত্বাবারাণী ঢ় হাদীছটি হাসান সনদে ‘মু‘জামুল কাবীরে’ উল্লেখ করেছেন; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৫৪৩, সনদ ছহীহ।
[১০] মাদারিজুস সালিকীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫২৬।
[১১] ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৫৫৩-৫৫৮।

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button