দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম

ব্যথার দান

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যানি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

লেখকঃ ড. আয়িদ আল করনী | অনুবাদঃ ডা. হাফেজ মাওলানা মােহাম্মদ নূর হােছাইন

দুঃখ-বেদনা সর্বদাই ঋণাত্মক শক্তি নয় এবং এমন কিছু নয় যাকে সর্বদা আপনার ঘৃণা করা উচিত। কখনাে কখনাে মানুষ ব্যথাবােধ করে উপকৃত হয়।

আপনি স্মরণ করতে পারেন যে, কখনও কখনও আপনি দুঃখবােধ করলে আল্লাহর নিকট আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করেছেন ও তাঁকে স্মরণ করেছেন। ছাত্র থাকাকালে প্রায়ই বিরাট বােঝার বেদনা (আতঙ্ক) বােধ করে। মাঝে মাঝে সম্ভবত একঘেঁয়েমির বােঝার আতঙ্কে ভােগে, তবুও অবশেষে সে ছাত্র জীবনের এ স্তর শেষ করে। শুরুতে সে ব্যথা-ভারাক্রান্তবােধ করে। কিন্তু শেষে সে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

প্রচণ্ড আবেগের ব্যথা-বেদনা, দারিদ্র; অন্যের অবজ্ঞা, ঘৃণা, অবিচার পেয়ে অত্যাচারিত হয়ে হতাশা ও ক্রোধ এসব কিছুই কবিকে সাবলীল ও বিমােহিতকারী কবিতার চরণ লিখতে বাধ্য করে। কারণ, সে তার হৃদয়ে, তার স্নায়ুতে যাতনা বােধ করে, ফলে তার কাজের (কবিতার) মাধ্যমে সে একই আবেগ অন্যের অন্তরে সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়। উত্তম লেখকদের কতই না বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়েছে- যে সব অভিজ্ঞতা চমৎকার কাজের (কবিতার, গল্পের, উপন্যাস ইত্যাদির) অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে-যেসব কাজ থেকে আজও উত্তর পুরুষেরা অনবরত আনন্দ ও উপকার লাভ করছে।

যে ছাত্র আরাম-আয়েশের জীবন কাটায় ও কষ্টভােগ করেনি বা যে ছাত্র কখনও দুর্দশাগ্রস্ত হয়নি সে অনুৎপাদী, অলস ও নিশ্চেষ্ট হবে।

বাস্তবিক, যে কবি কোন দুঃখ-বেদনার কথা জানে না, কখনও আশা ভঙ্গের তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ গ্রহণ করেনি, সে অতি অবশ্যই সস্তা শব্দের গাদাগাদা স্থূপ রচনা করবে। এটা এ কারণে যে, তার শব্দাবলী তার মুখ থেকে বেরােয়- তার আবেগ-অনুভূতি থেকে নিঃসৃত হয় না এবং যা সে লিখেছে, যদিও সে তা বুঝে তবুও তার দেহ মন জীবনে অভিজ্ঞতা লাভ করেনি।

প্রাথমিক যুগের মুমিনদের জীবন পূর্বোল্লিখিত উদাহরণসমূহের সাথে অধিকতর উপযুক্ত ও যুক্তিসঙ্গত। তারা কুরআন অবতীর্ণকালে জীবন যাপন করছিলেন এবং মানবজাতি চিরকালের দৃষ্ট সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাস্তবিকপক্ষে, পরবর্তীদের তুলনায় তাদের অধিকতর বেশি ঈমান, মহত্তর আত্মা, অধিকতর সত্যবাদী জবান এবং গভীরতর জ্ঞান ছিল- তাদের এসব থাকার কারণ হলাে-তারা দুঃখ-কষ্ট ও ভােগান্তির মধ্য দিয়ে বেঁচে ছিলেন। দুঃখ-কষ্ট ও ভােগান্তি এতদুভয়ই মহাবিপ্লবের প্রয়ােজনীয় সহগামী। ক্ষুধা, দারিদ্র, প্রত্যাখ্যান, গালি-গালাজ, বাড়ি-ঘর ও স্বদেশ থেকে বিতাড়ন, সকল আনন্দ বিসর্জন, আঘাত, অত্যাচার ও মৃত্যু যন্ত্রণা তারা ভােগ করেছিলেন। সত্যিই তাঁরা বাছাইকৃত, মানবজাতির সর্বাধিক অভিজাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁরা বিশুদ্ধতা, মহত্ত্ব ও উৎসর্গের নমুনা ছিলেন।

“কারণ আল্লাহর পথে তাদের তৃষ্ণা, ক্লান্তি, ক্ষুধায় কাতর হওয়া, কাফেরদের ক্রোধ উদ্রেক করে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং শত্রুদের পক্ষ থেকে ছি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া তাদের আমলনামায় সকর্মরূপে লিখিত হয়। নিশ্চয় আল্লাহ সকর্মপরায়ণদের কর্মফল নষ্ট করেন না।” [৯-সূরা তাওবা : আয়াত-১২০]

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তি আছেন, যারা তাদের মহত্তম কর্ম (রচনা) দুঃখকষ্ট ও ভােগান্তির অভিজ্ঞতা লাভ করার কারণেই সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। আরবী বিখ্যাত কবি মুতানাব্বি যখন সাংঘাতিক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল তখন তিনি তার কিছু উত্তম কাব্য রচনা করেছিলেন। নুমান ইবনে মুনযির যখন আন্নাবিগাহকে মৃত্যু ভয় দেখিয়েছিলেন, তখনই নাবিগাহ তার কিছু সর্বোত্তম কাব্য রচনা করেছিলেন। যে প্রসিদ্ধ পংক্তিটি তিনি বলেছিলেন তা হলাে

ভাবানুবাদ: আপনি হলেন সূর্য আর সব রাজারা তারকা, উদিত হলে সূর্য, দেখা যায় না একটিও তারকা।

বাস্তবিক, যাতনার অভিজ্ঞতা লাভ করার ফলে যারা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে ও কৃতিত্ব অর্জন করেছে তাদের অনেক উদাহরণ আছে।

সুতরাং, যখন আপনি যাতনার কথা ভাবেন, তখন অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে যাবেন না। এমনটা যুক্তিসঙ্গতভাবেই হতে পারে যে, দুঃখ-কষ্ট ও ভােগান্তির মধ্য দিয়ে আপনি আরাে শক্তিশালী হবেন। তাছাড়া আপনার জন্য দংশিত, জ্বলন্ত ও আবেগপ্রবণ আত্মা নিয়ে বেঁচে থাকা শীতল আত্মা ও অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গিযুক্ত লােকের উদাসীন অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে অধিকতর পবিত্র ও মহৎ।

“কিন্তু আল্লাহ তাদের অভিযানে প্রেরিত হওয়াকে অপছন্দ করলেন। তাই তাদেরকে পিছনে বসিয়ে রাখলেন এবং তাদেরকে বলা হলাে, যারা বসে আছে তাদের সাথে বসে থাক।” [৯-সূরা তাওবা : আয়াত-৪৬]

আবেগে ভরপুর ওয়াজ-নসিহতের শব্দাবলি সাধারণত এই কারণে অন্তরের অন্ত:স্থলে পৌঁছে যেতে পারে যে, নসিহতকারী নিজেই দুঃখ-কষ্ট ও ভােগান্তির অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।

“তিনি তাদের অন্তরে যা ছিল তা জেনেছেন ও তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ করেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন।” [৪৮-সূরা আল ফাতহ : আয়াত-১৮]

আমি বহু কাব্যগ্রন্থ পড়েছি এবং তাদের অধিকাংশই আবেগহীন, প্রাণহীন বা প্রেরণাহীন। এর কারণ হলাে যে, এসব গ্রন্থের রচয়িতারা কখনও কষ্টভােগ করেননি এবং এ কারণে যে ঐ পুস্তকগুলাে আরামদায়ক পরিবেশে সৃজন করা হয়েছে। এ কারণেই এ ধরনের লেখকদের লেখা বরফ খণ্ডের মতাে ঠাণ্ডা।

ওয়াজ-নসিহতে ভরা এমন অনেক কিতাব আমি পড়েছি যেগুলাে শ্রোতার শরীরের একটি পশমেও শিহরণ জাগাতে পারে না এবং সেগুলাের এক অণুর ওজনও নেই। বক্তা (যার ওয়াজ ছাপানাে হয়েছে) আবেগ-অনুভূতি নিয়ে অন্য কথায় ব্যথা-বেদনাসহ কথা বলছেন না (তাই এমনটি হচ্ছে)।

“তাদের অন্তরে যা নেই তা তারা মুখে বলে।” [৩-সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১৬৭]

আপনি যদি আপনার কথা, কাব্য অথবা কাজ দ্বারাও অন্যদেরকে প্রভাবিত করতে চান, তবে প্রথমে আপনার অন্তরের আবেগকে অনুভব করুন। অন্যকে আপনি যা জানাতে চাচ্ছেন, তা দিয়ে আপনার নিজেকে অবশ্যই শিহরিত হতে হবে। কেবলমাত্র তখনই আপনি বুঝতে পারবেন যে, আপনি অন্যদের উপর প্রভাব ফেলছেন।

“কিন্তু, যখন আমি এর উপর বৃষ্টি বর্ষণ করলাম, তখন এটা নড়ে-চড়ে, ফুলে-ফেঁপে উদাত হলাে।” [২২-সূরা আল হাজ্জ : আয়াত-৫]

উৎসঃ লা তাহযান [হতাশ হবেন না], ক্রমিক নংঃ ৩৮, পৃষ্ঠা: ৯৬ – ৯৯

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button