ধূমপান নীরব ঘাতক
প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যানি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।
ধূমপান নীরব ঘাতক
বর্তমান যুগের ঘৃণিত এক অভ্যাসের নাম ধূমপান। ধূমপান করে মানুষ বিভিন্ন মুসিবত ও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ধূমপান ধূমপায়ীদের অন্তর, রক্ত, শ্বাস-প্রশ্বাস, পেটের রোগ ও মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত করাসহ, পরিবেশও দূষণ করছে।
আশ্চর্য, কতক মানুষ ধূমপান নামের এ বিষ খরিদ করে গলাধঃকরণ করছে নেশার জন্য, অতঃপর তাতে মগ্ন থাকে মৃত্যু পর্যন্ত। অথচ ধূমপান তাদের মধ্যে নানা প্রকার ক্যান্সারের সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে ফুসফুসের ক্যান্সার। আপনি বলতে পারেন, ধূমপান ক্যান্সার সৃষ্ট করে প্রমাণ কি?
বিশেষজ্ঞগণ এর উত্তরে বলেন:
– ধূমপায়ীদের তুলনায় অধূমপায়ীদের মধ্যে ক্যান্সার রোগটি খুব কম।
– সিগারেটের সংখ্যা ও ধূমপানের স্থায়িত্বের পরিমাণ হিসেবে ফুসফুসের ক্যান্সার বাড়ে, যখন ধূমপান ছেড়ে দেয়া হয়, ধীরে ধীরে তার প্রকোপ কমতে থাকে, যা থেকে ফুসফুসের ক্যান্সার ও ধূমপানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক প্রমাণিত হয়।
– ফুসফুসে বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার হয়। যার উৎস ধূমপান, ধূমপানের ফলে তারই বৃদ্ধি ঘটে। যার সম্পর্ক ধূমপানের সাথে নেই, ধূমপানের কারণে তার বৃদ্ধি ঘটে না।
– কতক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, ধূমপান কণ্ঠ ও মূত্রাশয়ের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।
– ধূমপানের কারণে পেটে বিদ্যমান গর্ভের সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, গর্ভবতী ধূমপায়ী নারী অকাল গর্ভপাত ও ভ্রূণ বিনষ্টের সম্মুখীন হয়, অনেক সময় মৃত সন্তান জন্ম দেয়, কিংবা ভূমিষ্ঠের প্রথম সপ্তাহে তাদের সন্তান মারা যায়।
– ধূমপান নারীর নারীত্ব ও সৌন্দর্য বিনাশ করে, দাঁত হলুদ বানায় ও ঠোট কালো করে দেয়। অধিকন্তু ধূমপান নারীর আওয়াজের কোমলতা বিনষ্ট করে, মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে, যা সুগন্ধি ব্যবহারেও দূর হয় না।
– গবেষণা থেকে আরো প্রমাণিত হয়েছে যে, মায়ের ধূমপানের কারণে গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্কের ধমনী সংকুচিত হয় ও হ্রাস পায়। সিগারেটে বিদ্যমান গ্যাস খুব দ্রুত সন্তানের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। মায়ের পেট থেকে সন্তানের মধ্যে অনুপ্রবেশকালে এ গ্যাসের গতি রক্তের গতির চেয়ে কয়েকগুণ বেশী হয়।
– গবেষণা থেকে আরো প্রমাণিত হয়েছে যে, ধূমপানের ফলে মাথায় টাক হয়, চুল পড়ে যায়। দেখা গেছে সিগারেটের নিকোটিন অনেকের মাথা টাক বানিয়ে দিয়েছে।
– গবেষণা থেকে প্রমাণিত যে, ধূমপানে অভ্যস্ত ব্যক্তিরা ২১-২২ বছরের মধ্যে টাক হয়, তাদের অনেকে চৌদ্দ কিংবা পনের বছর বয়সে ধূমপান আরম্ভ করেছিল। ধূমপানের ফলে সৃষ্ট রোগ বংশগত রোগের আকার ধারণ করে। ধূমপায়ীরা অন্যদের তুলনায় দ্রুত মাথার চুল হারায়।
যুবক ও উঠতি বয়সী ছেলেরা কেন ধূমপান করে?
বেশ কিছু কারণে ছোট বাচ্চারা ধূমপায়ী হয়ে ওঠে, তবে সবার ধূমপানের পিছনে কারণ একটি নয়, বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করছি:
– মাথা-পিতার অবহেলা।
– ধূমপানের প্রতি কৌতূহল।
– বন্ধুদের অনুসরণ।
– সিগারেটের ব্যাপক প্রসার।
ধূমপানের অভিশাপ থেকে কিভাবে মুক্ত হবেন?
প্রিয় পাঠক, এখন থেকে ধূমপান ত্যাগ করুন এবং তা ছেড়ে দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিন। এটাই হবে আপনার সাহসী উদ্যোগ ও সঠিক সিদ্ধান্ত। আশা করছি নিম্নে দেয়া আমাদের পরিকল্পনা আপনাকে সাহায্য করবে:
– ধূমপান ত্যাগ করার জন্য একটি সময় নির্ধারণ করুন এবং তা যেন হয় সবচেয়ে নিকটতম সুযোগ, নফসের টালবাহানাকে মোটেও প্রশ্রয় দিবেন না, যা আপনার নেয়া সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে।
– আল্লাহর নিকট সাহায্য চান এবং তাকে একনিষ্ঠভাবে আহ্বান করুন, যেন আপনাকে তার শক্তি ও সাহস দান করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যখন সাহায্য চাও, আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও”।
– ধূমপানের ক্ষতি ও তার অশুভ পরিণাম আপনার চোখের সামনে রাখুন। আর স্মরণ করুন যে, আল্লাহ আপনাকে অবশ্যই আপনার সুস্থতা, বয়স ও সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।
– যেসব বন্ধু আপনাকে পুনরায় ধূমপানে অভ্যস্ত করার জন্য চেষ্টা করে, আপনি তাদেরকে ত্যাগ করুন। স্মরণ করুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী: “মানুষ তার বন্ধুর স্বভাব গ্রহণ করে, অতএব তোমাদের প্রত্যেকের দেখা উচিত কাকে বন্ধু বানাবে”।
– আপনি সিদ্ধান্ত নিন, দৈনন্দিন ধূমপানের জন্য যে অর্থ অপচয় হত, কোন ফকির, ইয়াতিম অথবা অন্য কোন কল্যাণে তা খরচ করবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে, তাই উৎকৃষ্টতর ও প্রতিদান হিসেবে মহত্তর”। (সূরা আল-মুয্যাম্মিল: (২০)
কিভাবে আজীবন অধূমপায়ী থাকবেন?
ধূমপান ত্যাগ করার ফলে আপনি বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হবেন, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে অথবা ক্লান্তি অনুভব হবে অথবা শরীরে টানটান ভাব হবে কিংবা শরীর নেতিয়ে পড়বে অথবা ঠোঁট শুকিয়ে আসবে ইত্যাদি। এসব অবস্থা খুবই স্বাভাবিক, কারণ আপনার শরীর এখনো সিগারেটের নিকোটিনে অভ্যস্ত।
সামান্য সময়ের জন্য বিরতি নিন, এ সময়ে আপনার নফসকে কোন সুযোগ দিবেন না। খাবার পর কফি, চা ও অন্যান্য পানীয়, যাতে ক্যাফিন রয়েছে গ্রহণ করবেন না। শারীরিক ব্যায়াম ও মানসিক স্বস্তি আনয়নকারী কিছু গ্রহণ করুন, প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আর প্রত্যেক কঠিন মুহূর্তে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, তাকওয়া ও ইবাদত দ্বারা সাহায্য প্রার্থনা করুন।
মনে রাখবেন!
যেভাবেই হোক ধূমপান ত্যাগ করুন, যদি ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদ রোগের আশঙ্কা ও দ্রুত মৃত্যুর কারণগুলো ধূমপান ত্যাগে সহায়ক না হয়, তাহলে অন্তত স্বাস্থ্য ও সম্পদের হিফাজতের জন্য ধূমপান ত্যাগ করুন। ব্রিটেনের গবেষকগণ ধূমপায়ীদের বৈষয়িকভাবে উপকৃত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যা ধূমপান ত্যাগের ফলে অর্জিত হয়।
ধূমপান একটি ব্যয়বহুল অভ্যাস, বিশেষ করে ব্রিটেনে। অনুরূপ ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি ও বেলজিয়ামে সিগারেটের দাম অস্বাভাবিক।
গবেষকদের জরিপে প্রমাণিত যে, একজন ধূমপায়ী, দিনে যে এক প্যাকেট সিগারেট পান করে, সে ধূমপান ত্যাগ করে বছরে (২২০০) ডলার আয় করতে পারে।
ডাক্তার মাইক মার্ফি ইম্পেরিয়াল হোটেলে ব্রিটেনের ক্যান্সার গবেষণা সংস্থার সমাবেশে ‘রয়টার্স’-কে বলেন: “দৈনন্দিন দশটি সিগারেটের ব্যয়ও অনেক”।
মাইক মার্ফি আরো বলেন, উল্লেখ্য তার গবেষক টিম বিশ্ব তামাক প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ১৪ মার্চ তামাক খাতে ব্যয়ের উপর উক্ত জরিপ পরিচালনা করেছিল: “তামাক ত্যাগ করে সর্বপ্রথম আপনি নিজেই স্বাস্থ্যের দিক থেকে উপকৃত হবেন, যুক্তরাজ্যে প্রতি তিনজন ক্যান্সার রোগীর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় ধূমপানের কারণে। প্রত্যেকটি সিগারেট আপনার জীবন থেকে আনুমানিক ১১-মিনিট হ্রাস করে”।
মার্ফি ও তার টিমের গবেষকগণ বলেন, বংশগত রোগ যদি ধূমপানের কারণে বিস্তার লাভ করে, তাহলে ভবিষ্যতে তার চিকিৎসা একটাই যে, ধূমপান থেকে বিরত থাকা। ধূমপায়ীরা স্বীকার করবেন এটা বড় কোন বিষয় নয়।
তারা বলেন, ধূমপানের পেছনের দিনগুলো ব্যতীত সর্বদাই ধূমপান ত্যাগ করার সুযোগ রয়েছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা পঁয়ত্রিশ বছর হওয়ার আগেই ধূমপান ত্যাগ করেন, তারা প্রায় ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগের সব ধরণের ঝুঁকি থেকে মুক্তি থাকেন। আর পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করার পর ধূমপান ত্যাগ করলে অর্ধেক ঝুঁকি হ্রাস পায়।
মার্ফি আরো বলেন: “এখন যারা ধূমপান করছে, তাদেরকে ধূমপান ত্যাগ করার উপদেশ অধিক ফল বয়ে আনবে, আগামী বিশ থেকে ত্রিশ বছরে, তাদের তুলনায় যারা এ অভ্যাস ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে”।
তিনি আরো বলেন: “আপনি যত দ্রুত ধূমপান ত্যাগ করবেন, ততই আপনার শরীর ও অর্থের জন্য উপকারী”।
ফতোয়া:
ইসলামে ধূমপানের বিধান:
ধূমপান হারাম, কারণ ধূমপান কুরআনে বর্ণিত খবিস বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন:
﴿ وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡخَبَٰٓئِثَ ١٥٧ ﴾ [الاعراف: ١٥٦]
“এবং তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র (খবিস) বস্তু হারাম করে” (সূরা আল-আরাফ: ১৫৬)
﴿ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيمٗا ٢٩ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ عُدۡوَٰنٗا وَظُلۡمٗا فَسَوۡفَ نُصۡلِيهِ نَارٗاۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرًا ٣٠ ﴾ [النساء : ٢٩، ٣٠]
“আর তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা কর না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু। আর যে ঐ কাজ করবে সীমালঙ্ঘন ও অন্যায়ভাবে, আমি অচিরেই তাকে আগুনে প্রবেশ করাব। আর সেটি হবে আল্লাহর উপর সহজ”। (সূরা আন-নিসা: ২৯-৩০)
আমরা প্রশ্নকারীকে বলতে চাই, কুরআনে প্রত্যেক হারাম বস্তুর উল্লেখ নেই, বরং পবিত্র সুন্নতেও নেই। একটি সাধারণ নীতির কারণে ধূমপান হারাম, যেমন খবিস বস্তু হারাম, অনুরূপ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও তার নফসকে ধ্বংসকারী বস্তুও হারাম। অনুরূপভাবে অর্থের অপচয় করাও হারাম। আরো কিছু বিষয় আছে উম্মতের ইজমা দ্বারা হারাম, অথবা কিয়াসের দ্বারা অথবা শরীয়তের উদ্দেশ্যের বিপরীত হওয়ার কারণে হারাম, বা অন্য কোন কারণে। সাধারণ মুসলিম, যার কুরআনের হুকুম জানার যোগ্যতা নেই, তার জন্য আলেম ও জানা ব্যক্তি থেকে জেনে নেয়া এবং তার ফতোয়া মোতাবেক আমল করাই যথেষ্ট। তারা যদি তাকে হারাম অথবা হালালের দলিল পেশ করে, তাহলে খুব ভালো। আল্লাহর হুকুম যে জানল, তার উচিত দ্রুত তার বাস্তবায়ন করা, বিস্তারিত দলিলের পিছনে না ছুটা। শুধু কুরআনের দলিলকেই যথেষ্ট জ্ঞান করা, অথবা কুরআন ও সুন্নার জ্ঞানের উপর সন্তুষ্ট থাকা। কারণ ইসলামী শরীয়তের আরো অনেক দলিল রয়েছে, যেমন ইজমা, কিয়াস, ইস্তেহসান, ইস্তেসহাব এবং মাসালেহে মুরসালাহ ইত্যাদি। আল্লাহ ভালো জানেন।
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ।
ধূমপান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ডাউনলোড করুন।
মন্তব্য করুন