ইসলামে পরিবারের মর্যাদা
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
লেখক: শাইখ মোহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ
প্রশ্ন: ইসলাম পরিবারের দিকে কোন দৃষ্টিতে দেখে? পুরুষ, নারী ও শিশুদের ভূমিকাকে কিভাবে দেখে?
উত্তর:
আলহামদুলিল্লাহ। ইসলামে পরিবার গঠন, নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে জানার আগে আসুন আমরা একটু জেনে নিই ইসলাম পূর্ব যুগে পরিবার ব্যবস্থা কেমন ছিল এবং আধুনিক পাশ্চাত্যে পরিবার ব্যবস্থা কেমন?
ইসলাম পূর্বযুগে পরিবার ব্যবস্থা অত্যাচার ও অবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেখানে সব অধিকার ছিল পুরুষদের। আরেকটু বিশুদ্ধভাবে বললে: সব অধিকার ছিল প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের। স্ত্রী কিংবা মেয়ে ছিল অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত। এর উদাহরণ হচ্ছে- যদি কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে জীবিত রেখে মারা যেত তখন এ স্বামীর অন্য স্ত্রীর সন্তানেরা এ নারীকে বিয়ে করতে পারত এবং এ নারীর উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারত কিংবা এ নারীকে অন্য কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া থেকে বাধা দিতে পারত। শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষেরা উত্তরাধিকার সম্পত্তি পেত; নারী ও শিশুরা কোন অংশ পেত না। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দুর্নাম ও অবমাননাকর; সে নারী মা হোক, মেয়ে হোক, কিংবা বোন হোক। কারণ নারীরা বন্দি হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। কোন নারী বন্দি হলে সেটা ছিল তার পরিবারের জন্য দুর্নাম ও অবমাননাকর। এ কারণে মানুষ তার দুগ্ধপোষ্য মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দিত।
আল্লাহ্ তাআলা এ প্রসঙ্গে বলেন: “তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়, তার গ্লানির কারণে সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও কি তাকে রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কত নিকৃষ্ট!” [সূরা নাহল, আয়াত: ৫৮]
বৃহৎ অর্থে পরিবার বলতে বুঝাত- গোত্র; এ গোত্র গড়ে উঠত একের উপর অন্যে বিজয় লাভ করার মাধ্যমে; এমনকি সে বিজয় অন্যায়ভাবে হলেও। ইসলাম আগমন করার পর এসব অন্যায়কে মুছে দিয়ে ন্যায়ের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করে। এমন কি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে তার অধিকার প্রদান করে। অকালপ্রসূত ভ্রূণের অধিকারও নিশ্চিত করে; ভ্রূণের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ও ভ্রুণের জানাযার নামায আদায় করার মাধ্যমে।
বর্তমানে কেউ যদি পাশ্চাত্যের পরিবারগুলোর দিকে নজর দেয় তাহলে দেখবে পাবে পরিবারগুলোর অবস্থা নড়বড়ে ও নাজুক। পিতামাতা সন্তানদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। না চিন্তার জগতে, আর না চারিত্রিক ক্ষেত্রে। ছেলে: সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবে, যা ইচ্ছা তাই করবে। অনুরূপ অবস্থা মেয়ের ক্ষেত্রেও। স্বাধীনতা ও অধিকারের নামে মেয়ে যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে আড্ডা দিবে, যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে ঘুমাবে। ফলাফল কী? ফলাফল হচ্ছে- নড়বড়ে পরিবার, বিয়ে বহির্ভূত শিশুদের জন্ম, (বয়স্ক) পিতামাতার সেবাযত্মহীন জীবনযাপন। জনৈক জ্ঞানী লোক বলেছেন: যদি আপনি এ সমাজের আসল চিত্র দেখতে চান তাহলে জেলখানায় গিয়ে দেখুন, হাসপাতালে যান , কিংবা ওল্ড হোমগুলো ভিজিট করুন। সন্তানেরা তাদের পিতামাতাকে উৎসব ও উপলক্ষ ছাড়া চিনে না।
দেখা যাচ্ছে, অমুসলিমদের কাছে পরিবার প্রথা ভগ্নপ্রায়। ইসলাম আগমন করার পর পরিবারের ভিত মজবুত করা, পরিবারকে ক্ষতিকারক সবকিছু থেকে হেফাযত করা এবং পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত রাখার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। এর সাথে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে: ইসলাম নারীকে মা হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বোন হিসেবে মর্যাদাবান করেছে। মা হিসেবে নারীকে মর্যাদাবান করেছে। দলিল হচ্ছে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বলল: ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার বেশি অধিকার কার? তিনি বললেন: তোমার মায়ের। লোকটি বলল: এরপর কার? তিনি বললেন: তোমার মায়ের। লোকটি বলল: এরপর কার? তিনি বললেন: তোমার মায়ের। লোকটি বলল: এরপর কার? তিনি বললেন: তোমার পিতার।” [সহিহ বুখারী (৫৬২৬) ও সহিহ মুসলিম (২৫৪৮)]
ইসলাম মেয়ে হিসেবেও নারীকে সম্মানিত করেছে: আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তির তিনজন মেয়ে, কিংবা তিনজন বোন কিংবা দুইজন মেয়ে বা দুইজন বোন রয়েছে, সে যদি এদের সাথে ভাল ব্যবহার করে এবং এদের ব্যাপারে আল্লাহ্কে ভয় করে চলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [সহিহ ইবনে হিব্বান (২/১৯০)]
ইসলাম স্ত্রী হিসেবেও নারীকে সম্মানিত করেছে: আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আমি আমার পরিবারের কাছে উত্তম।” [সুনানে তিরমিযি (৩৮৯৫), ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]
ইসলাম নারীকে মিরাছ ও অন্যান্য অধিকার প্রদান করেছে। ইসলাম অনেক বিষয়ে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “নারীরা পুরুষদের মত (আখলাক ও প্রকৃতির ক্ষেত্রে)।” [সুনানে আবু দাউদ (২৩৬) কর্তৃক আয়েশা (রাঃ) এর হাদিস, আলবানী সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে (২১৬) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]
ইসলাম নারীর ব্যাপারে ওসিয়ত করেছে, নারীকে স্বামী নির্বাচন করার স্বাধীনতা দিয়েছে। সন্তান প্রতিপালনের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের বড় অংশ নারীর উপর অর্পন করেছে। ইসলাম পিতামাতার ওপর সন্তান লালনপালনের গুরু দায়িত্ব আরোপ করেছেন: আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, “তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। শাসক দায়িত্বশীল; তাকে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবারে দায়িত্বশীল; তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কাজের লোক তার মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল। তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আরও বলেন: আমি এ কথাগুলো রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি।” [সহিহ বুখারী (৮৫৩) ও সহিহ মুসলিম (১৮২৯)]
ইসলাম পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করা, তাদের সেবাযত্ম করা এবং মৃত্যু অবধি তাদের আনুগত্য করার নীতি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াশ চালিয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন: “আর আপনার রব আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করতে ও মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তারা একজন বা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল।” [সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৩]
ইসলাম পরিবারের ইজ্জত, সম্মান, পুতঃপবিত্রতা ও বংশ ধারা সুরক্ষা করেছে। ইসলাম বিয়ে করার প্রতি উৎসাহ জাগিয়েছে। কিন্তু, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাতে বাধা দিয়েছে। ইসলাম পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে। পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে— লালনপালন, ইসলামী প্রতিপালন। সন্তানদের দায়িত্ব হচ্ছে পিতামাতার কথা শুনা ও আনুগত্য করা এবং ভালোবাসা ও সম্মানের ভিত্তিতে পিতামাতার অধিকারগুলো সংরক্ষণ করা। ইসলামে পারিবারিক এ মজবুতির সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য হচ্ছে ইসলামের শত্রুদের সাক্ষ্যবাণী।
আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
মন্তব্য করুন